7418
Published on মার্চ 1, 2022একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চের ১ তারিখ থেকেই বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির নিয়ন্তা। কারণ মার্চের প্রথম দিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো দেশ চলতে শুরু করেছিল। সেদিনের রেসকোর্স ময়দান ও বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৭ মার্চের ভাষণটিকে কেন্দ্র করে দশ লাখেরও বেশি মানুষের সমাবেশ মানব ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে দীর্ঘদিনের শোষণ বঞ্চনা থেকে বঙ্গবন্ধু যখন জনগণের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখনই পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে। এ ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ উত্তাল জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’—এসব স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশ তখন মিছিলের সমুদ্র। বঙ্গবন্ধু জানান বিনা চ্যালেঞ্জে তিনি কোনো কিছুই ছাড়বেন না। ছয়দফার প্রশ্নে আপস না করারও ঘোষণা আসে। ১ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলতে থাকে। ছাত্রলীগ আর ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গণজাগরণের এই পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ ছিল স্মরণীয় দিন। সাতই মার্চের ভাষণের মধ্যে কলকাতার অধুনালুপ্ত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার এককালের সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং উপমহাদেশের দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারার দর্শনের প্রভাব অর্থাত্ গান্ধীজির নিরস্ত্র নৈতিক যুদ্ধের আহ্বান এবং নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক দর্শন। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী ধাপেরও নির্দেশ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে। উপরন্তু ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যটি সারা দুনিয়ার নির্যাতিত মানুষের কাছে মুক্তিমন্ত্রতুল্য। খ্যাতিমান গবেষকের মন্তব্য, ‘বাঙালির মুক্তির সনদ ছিল এই ভাষণটি। এই দিনই রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। পাকিস্তানকে বাঙালিরা প্রত্যাখ্যান করে।’
সাতই মার্চের ভাষণের পর সারাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে; আর ৮ মার্চ থেকে ৭টি সেনানিবাস বাদে বঙ্গবন্ধুর শাসন সমগ্র প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের শাসন সংহত করার জন্য ৩১টির বেশি নির্দেশ জারি করা হয়। নির্দেশাবলি সমাজের সর্বস্তরে যথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অফিস-আদালত, কলকারখানা, রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ, রেডিও-টিভি সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে প্রাদেশিক সরকারের কাজ চলছিল। বাস্তবে একটি সমান্তরাল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একে একে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পালা শুরু হয়। রেডিও-টিভির পর কারাগার কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রধান আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে। ১২ মার্চ সকল সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসাররা বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুষ্ঠানিক সমর্থন ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের কাছ থেকে নির্দেশ গ্রহণের ইচ্ছার কথা জানান। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স বর্জন এবং অন্যান্য কর্মসূচিসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশব্যাপী সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত দেশের মানুষের কাছে খুবই যথার্থ ছিল। ১২ মার্চ লন্ডনের ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় বলা হয়, জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং অন্যান্য মহলের লোকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু মিলিটারি ব্যারাক ও সৈন্যবেষ্টিত বিমানবন্দরের ওপর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে বলে মনে হয়। ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতির মাধ্যমে হরতাল অব্যাহত রাখাসহ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশের মধ্য দিয়ে তাঁর সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণের সকল দিক সম্পন্ন হয়। ২৩ মার্চ নিজের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট হাউজে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই কর্তৃত্বেরই অংশ ছিল। পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগসহ অন্যান্য কর্মসূচি শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৬৯ সালের ৭ নভেম্বর পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘মুজিব প্রকৃতপক্ষেই পূর্ব পাকিস্তানের মুকুটহীন সম্রাট।’ ১৯৭১-এর ১ মার্চে এসে সেই মুকুটহীন সম্রাট জনগণের প্রিয় শাসকে পরিণত হলেন এবং দেশ চলতে আরম্ভ করল তাঁরই নির্দেশে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহান যথার্থই লিখেছেন, ‘আমার ধারণায়, ১৯৭১ সালের পহেলা থেকে ছাব্বিশ মার্চ—এই ছাব্বিশ দিনেই বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে এক স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছিল...।’
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস