2208
Published on ডিসেম্বর 10, 2018স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনঃ
তখন ডিসেম্বর মাস শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত আক্রমণে সংকুচিত হয়ে ঢাকার দিকে ঘাঁটি গাড়ছে পাকিস্তানিরা। সেই সময় ঢাকায় একটি বড় ধরনের অপারেশনের পরিকল্পনা চলছিল। আমেরিকান ইনফরমেশন সেন্টার গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ওটা ছিল ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর একটি। আমি তখন বুয়েটে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। গোপীবাগের ভাড়া বাসায় স্ত্রী আর এক বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই আমি আর আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু যুদ্ধে যোগ দেই। আমি প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম দেশেই। ভারতে যাইনি প্রশিক্ষণের জন্য। আমেরিকান ইনফরমেশন সেন্টার অপারেশনে অস্ত্র সংগ্রহ করে আমার বাসায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল। আমার বন্ধু স্থপতি মুজাহিদ আলম তার গাড়িতে করে অস্ত্র নিয়ে আসবে মানিকনগরে। বিশ্বরোডের একপাশে কমলাপুর-গোপীবাগ আর একপাশে প্রত্যন্ত গ্রাম মানিকনগর। মেঠোগ্রাম হওয়ায় সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেত না। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তাঞ্চলের মতো যাতায়াত করতো। পরিকল্পনা হলো মুজাহিদ তার ভক্সওয়াগন গাড়িতে অস্ত্র নিয়ে মানিকনগরে আসবে। আমি সেখান থেকে হাতে হাতে অস্ত্র পার করে আমার বাসায় এনে মজুদ করব। নির্ধারিত সময়ে আমি গিয়ে দেখি সে এখনো আসেননি। এদিকে অস্ত্র না আসলে এতো বড় অপারেশন কিভাবে করব সে চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। বারবার বাসায় আসছি আর অস্ত্র মজুদের জায়গায় যাচ্ছি। আমার এই হন্তদন্ত অবস্থা দেখে রাস্তার মধ্যে ৮-১০ বছরের এক ছেলে বললো, ‘স্যার কিছু আনন লাগবো’। ওকে বললাম না কিছু আনতে হবে না। এরপরে আমি আরও কয়েকবার ওই জায়গা থেকে ঘুরে আসলাম। বারবার আমার এভাবে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছিল। গোপীবাগে ওই সময় মানুষের বসতি খুব একটা ছিল না। ওই ছেলেটাও আমার সঙ্গে যাওয়া-আসা করছিল আর বলছিল কিছু আনতে হবে কিনা। তখন অতো কিছু চিন্তা না করে ওকে বললাম, হ্যাঁ, কিছু জিনিস আনতে হবে’। ও ধরিয়ে দিতে পারে বা কাউকে বলে দিতে পারে এটা তখন মাথায় আসেনি। ওই ছেলেটিকে অস্ত্র আনার বিষয়ে বলে ওই জায়গা আর আমার বাসা দেখিয়ে দিলাম। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পায়চারি করছি। মিনিট দশেক পড়ে দেখি ছোট্ট ছেলেটি ঘাড়ে একটি বাজারের ব্যাগ ফেলে শিষ বাজিয়ে সুভাষ দত্ত পরিচালিত সুতরাং ছবির ‘এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না’ গানটি গাইতে গাইতে হেঁটে আসছে। বাজারের ব্যাগ থেকে পুঁইশাক, কলমিশাকের ডগা বেরিয়ে আছে। এভাবে কয়েকবারে সে সম্পূর্ণ অস্ত্র আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। স্টেনগান, বিস্ফোরক সব কিছুই সে বয়ে এনেছিল। ঢাকার মধ্যে চালানো ওই অপারেশনে সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছিল।
সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন