2224
Published on ডিসেম্বর 10, 2018একাত্তরের মার্চে সামরিক পোশাক ছেড়ে ছেঁড়া লুঙ্গি পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন আবদুল জলিল খান। তাঁকে রাখা হয়েছিল এমন একটি ক্যাম্পে যেখানে বাঙালি নারীদের পাশবিক নির্যাতন করা হতো। একপর্যায়ে তিনজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে জলিল ওই নারীদের নিয়ে পালিয়ে আসেন।
মানিকগঞ্জের বায়রা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিল খান জানান, ১৯৬৯ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। রাওয়ালপিন্ডির একটি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে তাঁর পোস্টিং ছিল। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে তিন মাসের ছুটিতে বাড়িতে আসেন। ছুটি শেষে ১২ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তিনি যোগদানের জন্য রিপোর্ট করেন। কয়েক দিন পরই তাঁর রাওয়ালপিন্ডি যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। ওই সময় তিনিসহ কয়েকজন বাঙালি সেনা সদস্য থাকতেন বর্তমান বনানী রেলস্টেশনের কাছে একটি টিনশেড ক্যাম্পে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে গোলাগুলির শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায়। পরের দিন তাঁরা সাদা পোশাকে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান। আবদুল জলিল ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে টঙ্গী হয়ে মানিকগঞ্জে বাড়ির দিকে রওনা দেন। কিন্তু টঙ্গীর কাছাকাছি পাকিস্তান আর্মি তাঁকে এবং সঙ্গে থাকা আরো দুজনকে ধরে ফেলে। ওই দুজনের একজন ছিলেন মিরপুরের আব্বাস নামের কসাই, অন্যজন কুমিল্লার পাটোয়ারী। তাঁদের ধরে নেওয়া হয় বর্তমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে একটি সেনাক্যাম্পে কাজ করার জন্য। পাকিস্তানি সেনারা বুঝতে পারেনি যে আবদুল জলিল সেনা সদস্য। আব্বাসের পরিচয় পেয়ে তাঁকে দিয়ে ক্যাম্পের গরু-ছাগল জবাইয়ের কাজ করাত।
আবদুল জলিল জানান, ‘ওই ক্যাম্পে ৫০-৬০ জন বাঙালি নারীকে পাশবিক নির্যাতন করা হতো। পাকিস্তানি সেনারা দল বেঁধে এসে ধর্ষণ করত ওই নারীদের। নারীদের শরীর ছিল ক্ষতবিক্ষত। তাদের খেতে দেওয়া হতো না। এদের বেশ কয়েকজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রী।’ আবদুল জলিল জানান, তাঁদের সামনেই নির্যাতন করা হতো মেয়েদের। তাদের মধ্যে কেউ মরে গেলে পাশের বিলে মরদেহ ফেলে দেওয়া হতো।
মুক্তিযোদ্ধা জলিল জানান, ওই ক্যাম্পে তিনজন পাকিস্তানি সেনা পাহারায় থাকত। তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন পালানোর। বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রথমে কথা বলেন আব্বাসের সঙ্গে। পরে পাটোয়ারীর সঙ্গে কথা বললে তিনিও রাজি হন। পরিকল্পনা হয় পাহারাদার তিন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে পালানোর। আব্বাসের কাছে আগে থেকেই বিভিন্ন সাইজের তিন-চারটি চাপাতি ছিল। আটক হওয়ার কয়েক দিন পর সন্ধ্যার দিকে সুযোগ হয়। ওই সময় প্রহরায় থাকা তিনজন ছাড়া আর কোনো পাকিস্তানি সেনা ছিল না। সন্ধ্যার দিকে ওই তিন সেনাকে খাবার দেন আবদুল জলিল। তারা যখন খাবার খাওয়ায় ব্যস্ত তখন জলিল ও আব্বাস দুটি চাপাতি নিয়ে হামলা চালান। কোনো ধরনের বাধা দেওয়ার আগেই তিন সেনাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে নারীদের নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তারা দৌড়াতে থাকেন। দুই দিন পর জলিল সিংগাইরে বাড়িতে পৌঁছতে পারেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিংগাইরের এক নারী এবং ধামরাইয়ের এক নারী। তাঁরাও পরে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছান।
জলিল বলেন, ‘বাড়িতে আসার কয়েক দিন পর সিংগাইর থানা পুলিশ আমার খোঁজে আসে। তবে আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। পুলিশ জানায়, সেনাবাহিনী থেকে পালানোর অভিযোগে জলিলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। কয়েক দিন অন্য গ্রামে পালিয়ে থাকি। এর মধ্যে একদিন শুনতে পাই, হরিরামপুরে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শুরু হয়েছে। এলাকার আরো কয়েকজন মিলে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। আমাদের কমান্ডার তোবারক হোসেন লুডুর বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। লুডু বাহিনীতে আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয় ট্রেনার কমান্ডার হিসেবে। তবে ট্রেনিং দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযানেও নিয়মিত অংশ নিয়েছি।
জলিল জানান, বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা। তবে সে সবের মধ্যে ২৯ অক্টোবর গোলাইডাঙ্গার যুদ্ধ ছিল অন্যতম সফল অভিযান। ওই সময় লুডু বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করছিলেন গোলাইডাঙ্গা স্কুলে। পাকিস্তান বাহিনী দালালদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানতে পারে। প্রায় এক শ পাকিসেনা সাতটি নৌকায় কালীগঙ্গা নদীপথে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে যায়। তবে আগেই খবর পেয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা। না পালিয়ে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেন তাঁরা। জলিল বলেন, ‘সে সময় বর্ষাকাল হওয়ায় নদীতে ছিল প্রচণ্ড স্রোত। গোলাইডাঙ্গা গ্রামের কাছে নদীতে ছিল বিশাল একটি কুম। নদী এখানে তিন ভাগে বিভক্ত হওয়ায় ওই কুমে ছিল প্রচণ্ড ঘূর্ণি আর স্রোত। আমাদের স্কুলে না পেয়ে ওই কুম পার হয়ে ফিরে যেতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের—এটা বুঝতে পেরে কুমের তিন পারে অবস্থান নিয়ে অ্যামবুশ পাতি। তবে হাতে গোনা কয়েকটি অটোমেটিক অস্ত্র ছাড়া বেশির ভাগই ছিল থ্রি নট থ্রি রাইফেল। সাতটি নৌকা কুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিন পার থেকে ফায়ার শুরু করি আমরা। ছয়টি নৌকাই ডুবে যায়। কেউ কেউ গুলি খেয়ে কিংবা সাঁতার না জানায় ডুবে মারা যায়। তবে একটি নৌকা পারে ভিড়তে পারে। ওই নৌকার পাকিসেনারা মেশিন গানসহ অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে একনাগারে গুলি ছুড়তে থাকে। আমরা পিছিয়ে যেতে শুরু করি। তবে আমি আটকে পড়ি একটি মাটির ডিবির আড়ালে। আমার হাতে ছিল একটি মার্ক টু রাইফেল। ঘাস ঢুকে যাওয়ায় রাইফেলের বোল্ট টেনে রিলোড করতে পারছিলাম না। গলার তাবিজ দাঁতে চেপে সরু করে রাইফেল পরিষ্কার করি। সচল হয় রাইফেল। পাকি সেনাদের গুলির একটু বিরতিতে ক্রল করে পিছিয়ে খেতের আইলে আড়াল নেই। পেছন থেকে সঙ্গীদের কাভার ফায়ারের সাহায্য না পাওয়ায় মনে হচ্ছিল, এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারব না। তবে মরার আগে দু-একটাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ারিংয়ে একটু বিরতির সুযোগে ভালো একটা কাভার পেয়ে যাই। সেখান থেকে গুলি করে তিন পাকিসেনাকে ফেলে দেই। ভরকে গিয়ে অন্যরা আবার গুলি শুরু করে। তবে ক্রলিং করে আমি নিরাপদ স্থানে ফিরে আসতে পারি।’
জলিল জানান, ওই যুদ্ধে ৮১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছিল এবং তাদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে এসেছিল।
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ