10830
Published on আগস্ট 12, 2018ড. আতিউর রহমানঃ
আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণ অবয়বে উদ্ভাসিত হচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে, সেই জাতিই ভাগ্যবান যার নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণার রসদ খুঁজে পায়। আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহত্তম অর্জন এবং সেই অর্জনের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একসময় একদল জ্ঞানপাপী অযথা কুতর্ক করে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করেছিল। এমনকি স্বাধীনতার ডাক কে দিয়েছেন, এমন সর্বজনবিদিত বিষয়কেও খুবই নোংরাভাবে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। আর দুঃখের কথা এই যে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই অপকর্ম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে ইতিহাস তার আপন গতিতেই এসব আবর্জনা দূর করে সঠিক পথেই এগিয়ে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও তার মূল প্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হতে দেখে আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন অনেকটাই আশ্বস্ত। দলমত নির্বিশেষে তিনি বাঙালি জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বল ‘আইকন’ হিসেবে দিন দিন আরও বিরাট হচ্ছেন। আরও প্রবল হচ্ছেন। আর সে কারণেই তাদের বিভ্রান্তি কেটে যাচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশকে নিয়ে তাই তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে সামিল হবার কথা ভাবছে। ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে প্রাণ হারান আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই আগস্ট বাংলার আকাশ-বাতাস-নিসর্গ প্রকৃতিরও অশ্রুসিক্ত হওয়ার মাস। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল অস্তিত্ব পড়ে আছে আজ বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। একথা বললে ভুল হবে না যে, বাংলাদেশের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাল্যকাল ও কৈশোর থেকে সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু সারাজীবন একটিই সাধনা করেছেন—আর তা হচ্ছে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা। নিজের মধ্যে লুক্কায়িত রাজনীতির বীজ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে দ্রুত অঙ্কুরোদ্গম হয়। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করলেই বুঝতে পারি কী অসীম সাহসী, গভীর স্বদেশপ্রেমিক, সুনিশ্চিত লক্ষ্যভেদী এবং জনদরদী এক ভূমিপুত্রের জন্ম হয়েছিল এই অভাগা দেশে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি পড়লেও তাঁর মানবিকতা ও স্বদেশ প্রেমের বড় মানসপটের সন্ধান পাই। ১৯৪৭ সালে জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক ও অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এই রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই বাঙালির নির্যাতিত-নিষ্পেষিত হবার ফাঁদ পাতা আছে। তাই ১৯৪৮ সালে তিনি গঠন করেন ছাত্রলীগ। এরপর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন করেন। দলটিতে শুরুতে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা ধর্মনিরপেক্ষ রূপ গ্রহণ করে। অনেক ত্যাগ, শ্রম, আন্তরিকতা, সততা দিয়ে সংগঠন দু’টি তৈরি করেছিলেন বলেই তিনি দ্রুত মানুষের আস্থা অর্জন করে জননন্দিত হন। একই সঙ্গে মানুষের মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেতনা সৃষ্টি করতেও তিনি সক্ষম হন এবং সর্বোপরি একটি জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা হন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিব এবং তাঁর সহযোগীবৃন্দ। বাংলা ভাষার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ঐ সালের ১১ মার্চ ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন গ্রেফতার ও কারাবন্দি হন। এটিই ছিল মাতৃভাষার আন্দোলনে প্রথম রাজনৈতিক কারাবরণ। এজন্য বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আগে ১১ মার্চই পালিত হতো ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে।
১৯৫৩ সালের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে বঙ্গবন্ধু দল গোছাতে আত্মনিয়োগ করেন। চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় লাভ করে। সরকার গঠনের সময় সোহরাওয়ার্দী বঙ্গবন্ধুকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘তুমি মন্ত্রিত্ব নেবা কি না?’ সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। পার্টির অনেক কাজ আছে, বহু প্রার্থী আছে দেখে-শুনে তাদের করে দেন।’ তা সত্ত্বেও তাঁকে মন্ত্রী করা হয়েছিল। তবে আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কারণে খুব বেশিদিন বিপুল ভোটে নির্বাচিত সরকার টিকতে পারেনি। এরপর জেল-জুলুম। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক। আপসহীন। পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়া থেকেই শাসকগোষ্ঠীর কোনো অন্যায়কে তিনি বিনা-চ্যালেঞ্জে যেতে দেননি। মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ করাই ছিল তাঁর স্বভাব। ধাপে ধাপে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। কালক্রমে মুক্তি-সংগ্রামের এক মহত প্রচ্ছদপট এঁকে বাঙালি জাতির জন্য এনে দেন স্বপ্নের স্বাধীনতা। সে কারণেই ষাট-সত্তরের দশকের তরুণদের কাছে শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা এই রাজনীতিক এক অনন্য ‘রোল মডেলে’ রূপান্তরিত হন। নিজে পরিশ্রমী কর্মী ছিলেন। কর্মী থেকে হয়েছেন বিচক্ষণ সংগঠক। সংগঠক থেকে হয়েছেন অতুলনীয় নেতা। নেতা থেকে জাতীয় নেতা এবং সবশেষে হয়েছেন জাতির পিতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু নিরন্তর এক দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন। মৃত্যুকে তুচ্ছ ভেবে তিনি এগিয়ে গেছেন অবিচল চিত্তে। এজন্যই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ। মহত্তম বীর। আর তিনিই সত্যিকারের বীর যিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। একাধিকবার তিনি নির্ভয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘বাঙালির স্বাধিকার’, ‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’— যাই বলি না কেন, এগুলোর অপর নাম ‘বঙ্গবন্ধু’। লাল সবুজের পতাকায় তিনি তাই হয়ে আছেন চিরস্মরণীয়। বরণীয়।
আজ বিশ্বব্যাপী যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম, সেখানেই বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর নির্ভেজাল স্বদেশী চিন্তা-চেতনা থেকে তারা শিক্ষা নেন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। সর্বদাই তিনি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সারাক্ষণ নির্যাতিত-শোষিত-হতদরিদ্র-মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা ভাবতেন— যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে ও চিন্তায়। বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন—এটাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে, বেকারত্ব দূর হবে—সেই ভাবনাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে। তিনি বলতেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে নিয়োজিত হন বঙ্গবন্ধু। দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে যেসব সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা শেষ করার মতো যথেষ্ট সময় তিনি পাননি। তবে ওই উদ্যোগগুলো তিনি নিয়েছিলেন বলেই এতদিনে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মজবুত পাটাতন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। সেই পাটাতনের ওপর ভর করেই গড়ে উঠছে বর্তমান বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রসরমান উন্নয়ন অভিযাত্রা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই করে গেছেন। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, কৃষির উন্নতি ছাড়া এ দেশের মানুষের সত্যিকার মুক্তি আসতে পারে না। কৃষকরাই এ দেশের প্রাণ। তারাই সোনার বাংলা গড়ার আসল কারিগর। তাই কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সদ্য স্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে তাৎক্ষণিক আমদানি, স্বল্পমেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ, কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার এবং কৃষকের মাঝে খাস জমি বিতরণ করে কৃষির উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য কৃষিব্যাংক স্থাপন করেন। অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকেও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে মনোযোগী হতে বলেন। উচ্চতর কৃষি গবেষণা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করেন। পাকিস্তানি শাসনকালের ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি এবং তাদের সকল ঋণ সুদসহ মাফ করে দেন। পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরদিনের জন্য রহিত করেন। ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বণ্টনের উদ্যোগ নেন। সংবিধানে সমবায় ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের ধারা যুক্ত করেন। পরিবারপিছু জমির সিলিং একশ’ বিঘায় নির্ধারণ করেন। শক্তিচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা বাড়ান। বিশ্ববাজারে সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সারে ভর্তুকি দিয়ে কৃষককে রক্ষা করেন।
নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু একটি দর্শন, একটি চেতনা। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজও আমরা এগিয়ে চলেছি একটি শোষিত-বঞ্চিত জাতির সার্বিক মুক্তির দিকে। বিশ্বাস, ধ্যান ও জ্ঞানে মুক্তিকামী জনতার মূলমন্ত্রের নাম বঙ্গবন্ধু। অপরের দুঃখ-কষ্ট বঙ্গবন্ধুকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করত। বঙ্গবন্ধু নিজের কিংবা তাঁর পরিবারের জন্য কখনোই কিছু চাইতেন না। খুবই সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়েও সরকারি বাসভবনে থাকতেন না। নিরাভরণ, ছিমছাম আর আটপৌরে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিতেই আমৃত্যু থেকেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্যাপক অগ্রগতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রবর্তক। সংবিধানে তিনি অর্থনৈতিক মুক্তিকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিষয়টি লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সাম্যভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। তাঁর অর্থনৈতিক আদর্শ ও কৌশল ছিল নিজস্ব সম্পদের ওপর দেশকে দাঁড় করানো। এজন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই হাতে নেন নানা উদ্যোগ। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ টেকসই প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আদর্শ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের পরিচয় পেয়ে গেছে। এখন আমরা দ্রুত এগুচ্ছি পুরোপুরি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে।
কোনো বিচারেই বাংলাদেশ এখন আর স্বল্পোন্নত দেশ নয়। তাই গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিটি বলেছে বাংলাদেশ একই সাথে উন্নয়নশীল দেশ হবার সবগুলো সূচক পূরণ করেছে। ২০২৪ সাল নাগাদ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের কাতারে যুক্ত হবে। ধারাবাহিকভাবে জাতীয় আয় বৃদ্ধি, মানব সম্পদের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করে বাংলাদেশ এই মর্যাদা লাভ করেছে। পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের আদলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশ দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তার নাগরিকদের জীবনের গড় আয়ু ৭২ বছরে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে শিক্ষার হার বাড়িয়ে, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ত্বরান্বিত করে বাংলাদেশ এই অসাধারণ উন্নতি সাধন করেছে। তবে আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তা সত্ত্বেও, একথা বললে ভুল হবে না যে এতো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে এই পর্যায়ের অগ্রগতি সত্যি বিস্ময়কর। এই অভাবনীয় উন্নয়ন অভিযাত্রাকে টেকসই করতে হলে সুশাসন ও সুশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সেজন্যে আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও প্রশাসনকে সর্বদাই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক থাকতে হবে। আর তাহলেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সমাজ এগিয়ে যাবে জোর কদমে। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। এই শোকের মাসে আমরা বঙ্গবন্ধুকে প্রাণভরে স্মরণ করছি। তাঁর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ অর্জনে আমরা যেন নিরন্তর অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকি সেই প্রত্যাশাই করছি। একই সঙ্গে আমাদের সর্বক্ষণ খেয়াল রাখতে হবে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে যেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার বাংলা’ অর্জনে কোনো ছেদ না পড়ে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক