5496
Published on মে 16, 2020এম. নজরুল ইসলামঃ
১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করা বাঙালি জাতি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দিশা হারায়। ইতিহাসের সেই বেদনার্ত কালো অধ্যায় কারো অজানা থাকার কথা নয়। সবারই জানা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক মহল ও দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় একটি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে নিজের বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন স্বাধীন বাংলাদেশের মহান রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আকস্মিক এই ঘটনায় জাতি তখন দিশেহারা। পাকিস্তানী স্টাইলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়। রাজনীতি হয়ে যায় গৃহবন্দি। প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। সান্ধ্য আইনের ঘেরাটোপে বন্দি অদ্ভুত এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয় দেশে। প্রাণ খুলে কথা বলার অধিকারও যেন ছিল না কারো। অপহৃত হয় মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্বাধীনতা। সেই অবরুদ্ধ দিনের অর্গল খুলে নতুন হাওয়ায় মন ভিজে যাওয়ার দিন ১৭ মে, ১৯৮১। মানুষের প্রাণের আকুতি ভাগাভাগি করে নেওয়ার এই দিনটি বাঙালির কাছে বিশেষভাবেই স্মরণীয়। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ পাবার দিন আজ। উর্দিধারী শাসকগোষ্ঠীকে প্রবল ঝাঁকুনি দেওয়ার দিন ১৭ মে। সর্বস্বহারা এক নারী হার্দিক ছোঁয়ায় আজকের এই দিনে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর আত্মিক স্বজন। দিশেহারা বাঙালি জাতি আজকের এই দিনেই খুঁজে পায় নতুন নেতৃত্ব, আস্থা ও বিশ্বাস। দেশের মানুষের হতাশা ও বেদনার দিন অপসারণের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে ১৯৮১ সালের আজকের এই দিনেই দীর্ঘ ছয় বছরের প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৭ মে বাঙালি জাতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। দেশ ও জাতির ইতিহাসের চাকা আজকের এই দিনটি থেকে পেয়েছিল নতুন গতি। দিশেহারা জাতি ১৯৮১ সালের এই দিনটিতে এসে খুঁজে পেয়েছিল নতুন আশ্রয়। বাঙালির ইতিহাস এই দিন থেকে নতুন করে লেখা হয়েছিল। এই দিন থেকেই বাংলাদেশে নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার শুরু। সে অভিযাত্রার কা-ারি শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে উন্নত বিশ্ব। আগামী দিনে এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নতুন অভ্যুদয় হবে, এমন ভবিষ্যত বাণীও করে রেখেছেন অর্থনীতির প-িত বিশ্লেষকরা। এই পথ পরিক্রমায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।
অথচ ১৯৮১ সালের আগে নিতান্তই আটপৌরে জীবন ছিল তাঁর। আর দশটা বাঙালি নারীর মতই প্রতিদিনের ঘরকন্না করে দিন কাটছিল তাঁর। কিন্তু রাজনীতি ছিল তাঁর রক্তকণায়। রাজনীতিবিদ বাবার আদর্শের পতাকা হাতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে শুরু হলো তাঁর নতুন পথচলা। দেশের প্রাচীন ও প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েই দেশে ফিরেছিলেন তিনি। সেদিন তিনি দেশে এসেছিলেন একা। কিন্তু তাঁর এই নিঃসঙ্গ একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে মোটেও অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে।
১৭ মে, ১৯৮১। সেদিন ঢাকার সব পথ মিশে গিয়েছিল বিমানবন্দর ও মানিক মিয়া এভিনিউতে। আসলে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছিল যে মানুষ, তারা বুঝেছিল, তাদের ত্রাতা আসছেন। আসছেন সেই দিকনির্দেশক, যিনি মুক্তির অগ্রযাত্রায় আসন্ন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন। মানুষের অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলনে নতুন গতি যে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে নতুন করে সূচিত হবে, তা বুঝতে এ দেশের মানুষের একটুও সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর মতো উদারপ্রাণ, মহৎ মানুষকে হারিয়ে এদেশের মানুষ তখন এমন কাউকে খুঁজছে, যাঁর ওপর শতভাগ নির্ভর করা যায়। মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবেই তাঁর ফিরে আসা এই মাটিতে।
তার পর এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বারবার শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়েছে তাঁকে। অন্তরীণ করা হয়েছে। হত্যার উদ্দেশে কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে তাঁর ওপর। ছোট একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি তৎকালীন সামরিক সরকার তাঁকে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রয়ারি ও নভেম্বর মাসে তাঁকে দুই বার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় তিন মাস গৃহবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। আগের দিন ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাঁকেসহ তাঁর গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে তাঁকে লক্ষ্য করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাঁকে লক্ষ্য করে দুই বার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রয়ারি আবার গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর তাঁকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর তাঁকে হত্যার জন্য বারবার হামলা করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং তাঁর জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুতে রাখা হয়। তিনি সেখানে পৌঁছার আগেই বোমাগুলো শনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি সরকারের সময় প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু এইভনিউতে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের সরকার। ক্ষমতায় এসে তিনি জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, বহির্বিশ্বে দেশের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি জাতির জনকের হত্যাকারীদের রক্ষাকবচ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে হত্যাকারীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করলেন। ১৯৯৭ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করেন। ১৯৯৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেন তার সাফল্যের জন্য ১৯৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনাকে ইউনেসকোর শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবজনক মর্যাদা পায়। আবার ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়।
সব চক্রান্তের জাল একে একে ছিন্ন করে তিনি বাঙালিকে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত সাধনা থেকে একটুও বিচ্যূত হননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে এই দেশে। কার্যকর হয়েছে দণ্ড। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এরই মধ্যে পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর দ- কার্যকর হয়েছে। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে সমাধান হয়েছে। বাস্তবায়িত হয়েছে সীমানা চুক্তি। বিনিময় হয়েছে ছিটমহল। দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, আন্তর্জাতিক আদালতে তার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ যে আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, তার শতভাগ কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আজ বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছে।
জনক্যলাণের ব্রত সাধনার মন্ত্রে নতুন দীক্ষা নিয়ে আজকের এই দিনে পিতৃভূমিতে পা রেখেছিলেন যিনি, আজও তিনি মানুষের মুক্তির প্রতীক। মানুষের কল্যাণ সাধনার ব্রত নিয়ে নতুন মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন বলেই নতুন করে জেগে ওঠা বাংলাদেশের প্রতীক শেখ হাসিনা। তাঁর জয় হোক। জয় হোক বাংলার মানুষের। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় আরো এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। জয় বাংলা।
লেখক: অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক