2929
Published on এপ্রিল 1, 2018১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।
কালোমুখো হনুমানের জন্য বিখ্যাত যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের যে নিষ্ঠুরতার রূপ দেখেছে তা হয়তো হনুমানের কৃষ্ণতাকেও হার মানায়। ১৯৭১ সালে কেশবপুর উপজেলায় রাজাকারদের ৪টি ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। আমিনউদ্দিন, দিন মোহাম্মদ, মওলানা সাখাওয়াত হোসেন ও আকবর হোসেনের নেতৃত্বে কেশবপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়, চিংড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভাণ্ডারখোলা কৃষি গুদাম ও ত্রিমোহনী বাজারে মুক্তিযোদ্ধা রজব আলীর বাড়ি দখলপূর্বক এসব ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। তবে কেশবপুর পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের কক্ষগুলো রাজাকার ক্যাম্পের সদর দপ্তর হিসেবে ও বিদ্যালয়ের একটি কক্ষকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সাগরদাঁড়ি ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ লোকজন ধরে এনে এই কক্ষে নির্যাতনের পর রাত্রিবেলা চোখ বেঁধে মঙ্গলকোট সেতুর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর সেতুর ওপর থেকে বুড়িভদ্রা নদীতে ফেলে দেয়া হতো।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়ি গ্রামের অতি নিকটবর্তী ছিল চিংড়া রাজাকার ক্যাম্প, যেখানে সর্বদা প্রায় ১০০ জন রাজাকার অবস্থান করত। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার হাকিমপুর মুক্তিবাহিনী শিবিরের অধিনায়ক কবির হোসেনের কাছে কেশবপুর উপজেলার ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা চিংড়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের ইচ্ছা পোষণ করেন। অধিনায়ক কবির হোসেন তাদের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণপূর্বক যশোর জেলার অন্যান্য থানার যুবকদের নিয়ে ১০ অক্টোবর হাকিমপুর বিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হতে নির্দেশ প্রদান করেন। নির্ধারিত দিনে প্রায় ৫০ জন যুবক উপস্থিত হলে কবির হোসেন অস্ত্র ও গোলাবারুদের স্বল্পতার কারণে তাদের মধ্য থেকে ২০ জনকে নিয়ে আক্রমণের জন্য একটি দল গঠন করে কাজী রফিকুল ইসলামকে দলের অধিনায়ক নির্বাচিত করেন। পরবর্তী সময়ে হাতিয়ার পাওয়া গেলে অন্যদেরও আক্রমণে প্রেরণ করা হবে বলে জানান তিনি।
১৩ অক্টোবর রাত ১২টার পর চিংড়া রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাই অধিনায়ক সবাইকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এরপর আক্রমণকারী দলকে দুটি উপদলে বিভক্ত করে প্রতিটি উপদলকে ১টি এলএমজি, ২টি এসএলআর, ২টি .৩০৩ রাইফেল, ২টি মার্ক ফোর রাইফেল, ১টি ইন্ডিয়ান এসএমজি, ২টি ব্রিটিশ এসএমজি ও প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে ২টি করে গ্রেনেড আর পুল ধ্বংস করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়।
১০ই অক্টোবর বিকাল ৫টায় উপদল দুটি হাকিমপুর শিবির থেকে চিংড়া গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়ে কলারোয়া থানার হিজলডাঙা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। মেঠো পথে অগ্রসর হয়ে ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা চিংড়ার নিকটবর্তী গোবিন্দপুর গ্রামে পৌঁছেন। অতি গোপনে দিনটি অতিবাহিত করে নিরাপত্তার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যার সময় কপোতাক্ষ নদ অতিক্রম করে কলারোয়া থানার জয়নগর গ্রামে অবস্থান নেন। এখান থেকে ১২ অক্টোবর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছদ্মবেশে চিংড়া রাজাকার ক্যাম্প রেকি করতে রওনা হন। তারা কপোতাক্ষ নদের দক্ষিণ পাড়ের শার্শা গ্রামের মধ্য দিয়ে অতি গোপনে রাজাকার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। ক্যাম্পটি মূলত একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও খাদ্যগুদামের সমনি¦ত রূপ, যা নদী তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত। মুক্তিযোদ্ধারা গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ক্যাম্প আক্রমণের চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করেন। তারা ১৩ অক্টোবর রাত প্রায় ১২টা নাগাদ কেশবপুর খেয়াঘাট অতিক্রম করে গোপনে চিংড়া বাজারের পশ্চিম পাশ দিয়ে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হন। কাজী রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা তিনটি উপদলে বিভক্ত হয়ে তিনটি সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে আক্রমণ রচনা করলে প্রাথমিক অবস্থায় রাজাকাররা দিশাহারা হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর তারাও পাল্টা আক্রমণ করতে থাকে।
কয়েক ঘণ্টা তুমুল লড়াইয়ের এক পর্যায়ে রাজাকারদের একটি বুলেটের আঘাতে অধিনায়ক কাজী রফিকুল ইসলামের কপাল ঘেঁষে চামড়াসহ চুল উড়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে তাকে নিয়ে দ্রুত পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সহযোদ্ধা বাবুকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে উপায়ান্তর না দেখে চিংড়া গ্রামেরই মুক্তিযোদ্ধা চাঁদতুল্লাহ গাজি নিজেই বাবুকে খোঁজার দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে দ্রুত স্থান ত্যাগের পরামর্শ দেন। কিন্তু এক ঘণ্টা পরে মুক্তিযোদ্ধা বাবু ফিরে এলেও তাকে খুঁজতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা চাঁদতুল্লাহ গাজি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পরদিন সকালবেলা রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে তাকে কপোতাক্ষ নদের তীরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত্যুর পূর্বে শেষ সুযোগ হিসেবে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলতে নির্দেশ প্রদান করলে তিনি পরপর দুই বার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। এতে রাজাকাররা ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। একজন রাজাকার তাকে গুলি করতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অপর রাজাকারের শরীরে গুলি লাগলে সে মারা যায়। তাৎক্ষণিক আরেকজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা চাঁদতুল্লাহকে পরপর দুটি গুলি করলে তিনি শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সেদিন মোট ৪ জন রাজাকার নিহত হয়।
১৩ অক্টোবরের হতাহতের পর রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তায় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে। নিহত ৪ জন রাজাকারের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিরীহ জনগণকে ধরে তাদের শিবিরে এনে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হতো। পরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো নদীতে নিক্ষেপ করা হতো। স্রোতের তোড়ে লাশগুলো ভেসে যেত। এই কারণে নিহতদের আত্মীয়স্বজনরা মৃতদেহগুলোর শেষকৃত্য করতে ব্যর্থ হন। তা ছাড়াও পাকিস্তানি সৈন্যরা এলাকার যুবতীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করার পর তাদেরও হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিত।
প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা এক ইউনিয়নের বা গ্রামের বাসিন্দাদের ধরে এনে অন্য ইউনিয়নে বা গ্রামে নিয়ে হত্যা করত, যেন তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অবগত হতে না পারেন। তেমনি শাহাপুর গ্রামের (ত্রিমোহনী ইউনিয়ন) পটল সর্দার, হিজলডাঙা গ্রামের (বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়ন) খোকন ও নাম না জানা আরো অনেককে তারা সাগরদাঁড়ির চিংড়া গ্রামে এনে হত্যা করে। তারা ওমর নামে একজন ব্যক্তিকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়, কিন্তু আহত অবস্থায় ওমর ফিরে আসতে সক্ষম হন।
লেখকঃ বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত
সৌজন্যেঃ দৈনিক ভোরের কাগজ