স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রঃ প্রফেসর ড. এম শাহ্ নওয়াজ আলি

7769

Published on মার্চ 28, 2018
  • Details Image

স্বাধীনতা মানুষের আজন্ম পিপাসা। আর এ পিপাসা থেকেই জন্ম নেয় সংগ্রামী চেতনার। এ সংগ্রামী চেতনাবোধই মানুষের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথকে সুগম করে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হওয়ার পর বাঙালি জাতির ওপর নেমে আসে আরেকটি নব্য উপনিবেশবাদ। দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের শেষ প্রহর এই অগ্নিঝরা মার্চ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার ঐতিহাসিক সমাবেশে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণার পর শুরু হয় পাকিস্তাানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এক অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধ। এরপর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ। কিন্তু কীভাবে প্রচারিত হয়েছিল সে ঘোষণা? কখন প্রচারিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী? কী ভূমিকা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের? কারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করতে যেসব বেতারকর্মী তথা শব্দসৈনিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তারা আজ ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী।

২৫ মার্চ কালরাতে রাজধানী ঢাকায় শুরু হয় বর্বরোচিত গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। ২৫ মার্চ রাতে রেডিও এবং টেলিভিশন কেন্দ্র দখল করে নেয়ার পর ২৬ মার্চ সকাল থেকেই রেডিও টিভিতে প্রচারিত হতে থাকে সামরিক নীতিমালা। হামলা চালিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, বিমান চলাচলসহ সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের ১৫ ঘণ্টার মাথায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে একজন বিদ্রোহীর কণ্ঠে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানানোর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। এটি ছিল চট্টগ্রামের জনপ্রিয় নেতা আবদুল হান্নানের কণ্ঠ। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মোটামুটি সংগঠিত আকারে চট্টগ্রাম কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে যাত্রা শুরু করে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায়। ২৫ মার্চ গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ইপিআরের ওয়ারলেসে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা পাঠানো হয়েছিল। যা হোক ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান অনির্ধারিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী পাঠের পর চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের বেতার ভবনের কর্মীরা দারুণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত ও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা নাসিরের পরামর্শে এবং শব্দসৈনিক বেলাল মোহাম্মদের প্রচেষ্টায় আগ্রাবাদ বেতার ভবন থেকে কালুরঘাটের ক্ষুদে স্টুডিওতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারণ আগ্রাবাদ বেতার ভবনটি চট্টগ্রাম বন্দরের খুব কাছে। পাকিস্তানিরা যে কোনো সময় বেতার কেন্দ্রটি দখল করে নিতে পারত। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঐতিহাসিক ও দুর্লভ মুহূর্তটি ঘনিয়ে আসে। ৭টা ৪০ মিনিটে প্রথম প্রচারিত হলো অধ্যক্ষ আবুল কাসেম স›দ্বীপের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। এরপর অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক, সুলতানুল আলমের কণ্ঠেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাটি বার বার প্রচার করা হয়। এর ২০/২৫ মিনিট পরে কালুরঘাট স্টুডিওতে এসে হাজির হন ডা. আবু জাফর এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। হান্নান সাহেব স্টুডিওতে উপস্থিত হয়ে বেতার কর্মীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন বলে জানান। কোথা থেকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তা বলা যাবে না এমন আপত্তিও হান্নান সাহেব মেনে নিয়েছিলেন। বেতার কর্মীদের যুক্তি ছিল স্থানের নাম ঘোষণা করা হলে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান জেনে ফেলবে এবং হামলা করবে। এ ছাড়া এটা ছিল গোপন বেতার কেন্দ্রও বটে। যুক্তি মেনে নিয়ে হান্নান সাহেব দ্বিতীয় বার নিজ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য তথ্য-উপাত্তে হান্নান সাহেবের দ্বিতীয় বার স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীতে কী লেখা ছিল সে তথ্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায়, বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক তারবার্তার কথামালার লিখিত বিবরণ ‘জরুরি ঘোষণা’- ‘গত রাত ১২টায় বর্বর পাক বাহিনী ঢাকার পিলখানা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে, এতে লাখ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছে। যুদ্ধ চলছে, আমি এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশগুলোর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি’-জয় বাংলা’। ২৬ মার্চ শুভ সন্ধ্যার সূচনা অধিবেশনের সময় ছিল মাত্র ৩০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বাণী পাঠের পর ‘আগামীকাল ৭টায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে’ এমন ঘোষণা দিয়ে কালুরঘাট রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে যায়।

আজকের তরুণ প্রজন্ম তথা স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতকারী ভণ্ড ও মিথ্যাবাদীদের জন্য যে তথ্য জানা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হলো আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান কর্তৃক দুইবার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর কেন কীভাবে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়ার আগমন ঘটে সে তথ্য জানা। তথ্যবহুল ও ঐতিহাসিক গ্রন্থে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের লেখক বেলাল মোহাম্মদ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালুর জন্য আমি, আবুল কাসেম স›দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক চট্টগ্রামের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর দপ্তরে যাই। কিন্তু নেতাদের কাউকে না পেয়ে চলে যাই রেলওয়ে বিল্ডিংয়ের পাহাড়ে। সেখানে ছিলেন ইপিআর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। প্রস্তাব দেয়া হলো বেতার কেন্দ্র পাহারার ব্যবস্থা করার। তিনি কথা দিলেন এক ঘণ্টার মধ্যে ২০ জন জওয়ান পাঠাবেন। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে বিকাল এসেছে, রাত হয়েছে, অনুষ্ঠান শেষ হয়ে স্টুডিও বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু রফিক তার কথা রাখেননি। এ পরিস্থিতিতে আমি আবুল কাসেম স›দ্বীপ ও আবদুল্লাহ আল ফারুক প্রচার ভবনে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি এবং বিশেষ সূত্রে জানতে পারলাম একজন বাঙালি মেজর দেড়শ সৈন্য নিয়ে পটিয়ায় অবস্থান করছেন। খবর পেয়ে বন্ধু মাহমুদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ ১৫/১৬ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সাক্ষাতে মেজর জিয়াকে বেতার ভবনের নিরাপত্তা দিতে অনুরোধ জানাই। মেজর জিয়া সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার অনুগত সৈন্যদের কালুরঘাটে পাঠান এবং তিনি নিজেও আমাদের সঙ্গে বেতার কেন্দ্রে চলে আসেন। আমরা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে পৌঁছি ২৭ মার্চ বিকেল ৫টায়। সন্ধ্যায় মেজর জিয়ার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে রেডিওতে জিয়াকে কিছু বলতে অনুরোধ করি এবং এক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ এগিয়ে দিই। মেজর জিয়া প্রথমে লেখেন, ‘আই এম মেজর জিয়া ডু হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার ইনডিপেন্ডেন্স অফ বাংলাদেশ’। কিন্তু আমি মেজর জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বলার অনুরোধ করি। জিয়াউর রহমান তাতে রাজি হয়ে আরো লিখেন, ঙহ ইবযধষভ ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ ঘধঃরড়হধষ খবধফবৎ ইধহমধনধহফযঁ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ. ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দ্বিতীয় বার এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা (৩য় বার) দেশের লাখো কোটি মানুষ শুনেছে। যদিও চাটুকার নেতা ও ইতিহাস বিকৃতকারীরা জিয়াকেই স্বাধীনতার একমাত্র ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারাও শুনেছেন ২৬ ও ২৭ মার্চে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীগুলো। সেদিন মেজর রফিক কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এলে ইতিহাস বিকৃতকারীদের সে সুযোগ পাল্টে যেত। প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এবং পরে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা বাণী পাঠের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে বাঙালিদের কাছে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকবেন আবুল কাসেম স›দ্বীপ, সৈয়দ আবদুস শাকের, বেলাল মোহাম্মদ, আমিনুর রহমান, এ এম শরিফুজ্জামান, রাশিদুল হাসান, রেজাউল করিম চৌধুরী, কাজী হাবিব উদ্দিন আহম্মেদ মনি, আবদুল্লাহ আল ফারুক এবং মুস্তফা আনোয়ার। স্বাধীন বাংলা বেতারের অকুতোভয় এ দশ শব্দসৈনিকের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

সময় থেমে থাকে না, চলছে চলবেই। অনুরূপভাবে ইতিহাসকে কোনোদিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। প্রকৃত ইতিহাস সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবেই। তাই স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যতই মিথ্যাচার হোক না কেন, স্বাধীনতার ঘোষক তথা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাঙালি জাতির হৃদয় থেকে কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।

লেখকঃ সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত