7428
Published on মার্চ 28, 2018১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতাকামী অদম্য সাহসী যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে প্রেরণের পিছনে এই জনপদের অবদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে হাটহাজারী হয়ে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত রাঙ্গামাটি সড়ক, বড়দিঘির পাড় থেকে সীতাকুন্ড সড়ক ছাড়াও চট্টগ্রাম শহর থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। অর্থাৎ এই জনপদ বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একটি গুরত্বপূর্ণ সংযোগস্থল ছিল উভয়পক্ষের জন্য। চট্টগ্রাম সেনানিবাস হাটহাজারীতে অবস্থিত থাকায় পাক হানাদার বাহিনী ওসব সড়ক দিয়ে সবসময় চলাফেরা করত। অপরদিকে মুক্তিপাগল স্বাধীনতাকামী যুবকরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধলই ও ফরহাদাবাদে এসে সংগঠিত হতো। ওই দুটি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদের সার্বিক সহযোগিতায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যাওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। যে স্থান থেকে ভারতে প্রেরণ করা হতো সেই ঐতিহাসিক স্থানটির নাম বংশালঘাট। হাটহাজারীর মধ্যে ধলই ও ফরহাদাবাদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্গকে নির্মূল করার জন্য পাক হানাদার বাহিনীর চারটি সামরিক ঘাঁটির মধ্যে একটি ছিল হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে অদুদিয়া সিনিয়র সুন্নিয়া মাদ্রাসা যা টর্চার সেল নামে পরিচিত ছিল। বাকি তিনটি সামরিক ঘাঁটির অবস্থান ছিল কাটিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়, নাজিরহাট ডিগ্রি কলেজ ও উদালিয়া চা বাগান। এই ৩টি ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণের গতিবিধির উপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখা হতো। প্রায় সময় রাজাকারদের সহযোগিতায় গ্রামের ভিতর ঢুকে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করত পাক বাহিনী। নিরীহ যুবক-যুবতীদের ধরে নিয়ে হাটহাজারী টর্চার শেলে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করত। এমনকি বিবস্ত্র করে মহিলাদের চুল কেটে নারী-পুরুষ একসাথে রাখা হতো। অনেকেই ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পালিয়ে বেঁচে যায়। তাদের মধ্যে একজন ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন। তার বয়ানেই এসব তথ্য জানা যায়।
হাটহাজারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু ছোট-বড় অপারেশনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কাটিরহাট-ধলই অপারেশন। বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন এই অপারেশনের বিবরণ দিয়ে বলেন, ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনীর শতাধিক সদস্য কাটিরহাট বাজারের পূর্বদিকে গুলি করতে করতে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করতে থাকে। একপর্যায়ে পাক বাহিনীর গুলিতে সিরাজুল হক নামে এক নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। এ খবর আমাদের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে থানা কমান্ডার এস.এম. কামাল উদ্দীনের (সিইনসি স্পেশাল) সভাপতিত্বে বংশাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সংগঠকদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নরঘাতক পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কিভাবে এবং কোনো পদ্ধতিতে মোকাবিলা করে তাদের নির্মূল বা পরাজিত করে এলাকার জান-মাল ও মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করা যায় সেই কৌশল নির্ণয় করার জন্য বিস্তারিত আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকরা এলাকা ত্যাগ করে অন্য কোথাও যাবেন না। সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা তাদের কাছে যা অস্ত্র আছে তা দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে জীবণ-মরণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন ও সর্বক্ষণ পাক-বাহিনীকে অস্থির রাখবেন। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য কয়েকটি পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত হয়। কৌশলগুলো হলো- কমান্ডারের নেতৃত্বে ২০টি গেরিলা টিম গঠন করা। প্রত্যেকটি টিমে পাঁচ জন করে অস্ত্রসহ মুক্তিযোদ্ধা থাকবে। শত্রু পক্ষ যাতে কোনো বাড়িতে অবস্থান নিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করতে না পারে সেজন্য গোপন জায়গা থেকে দু’একটি গুলি বা প্রয়োজনে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে হবে। যাতে আমাদের একটি গুলির বিনিময়ে শত্রু পক্ষ শত শত গুলি ছোঁড়ে; এতে করে তাদের হাতে মজুদ থাকা গোলা-বারুদ শেষ হয়ে যাবে। তাদের পরাজিত করতে হলে প্রথমে গেরিলা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। পরে মরণপণ সম্মুখযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুতবেগে গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়ে এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক গেরিলা কায়দায় অপারেশন আরম্ভ হয়। শত্রুপক্ষের গতিবিধি লক্ষ্য করে দু’একটি গুলি ও মাঝে মধ্যে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করার বিনিময়ে পাক হানাদার বাহিনী শত শত গুলি ছুঁড়তে থাকে। গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শুরু করেন, তখন রাজাকারদের মধ্যে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হওয়ার পর সব রাজাকারই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। পথ দেখানোর জন্য কারো সহযোগিতা না পেয়ে এলোপাথাড়ি গুলি করতে করতে পূর্বে হালদা নদীর পাড় হয়ে দক্ষিণে সেকান্দার পাড়া, উত্তরে বংশালঘাট, পশ্চিমে সৈয়দ কোম্পানির বাড়ি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে পাক বাহিনী। দিশাহারা অবস্থায় এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকে তারা। কোথাও অবস্থান নেয়ার মতো সুযোগ পাক বাহিনীকে দেয়নি মুক্তিযোদ্ধারা। প্রত্যেকটি জায়গায় পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পড়ন্ত বিকেলে পাকবাহিনী আত্মরক্ষামূলক গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে কাটিরহাট ঘাঁটিতে চলে যাবার পথ খুঁজতে থাকে, তাদের হাতে থাকা গোলা-বারুদ ফুরিয়ে গেলে মনোবলও ভেঙে পড়ে। এ ধারণা নিশ্চিত হওয়ার পর সব গেরিলা টিম তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড জীবন-মরণ সম্মুখ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে শত্রু পক্ষের প্রায় নয় জনের মতো সৈন্য নিহত হওয়ার পর তীব্র আক্রমণের মুখে পর্যদুস্ত হয়ে পরাজয়ের গøানি নিয়ে লোকালয় ছেড়ে তাদের ঘাঁটি কাটিরহাটে চলে যেতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে সন্ধ্যার মধ্যেই কাটিরহাট ঘাঁটি ও উদালিয়া চা বাগান ত্যাগ করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পালিয়ে যায় হানাদাররা। এ দিনেই উত্তর হাটহাজারী পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকার মুক্ত হয়।
সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ