সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ১৯ মার্চঃ আ ক ম মোজাম্মেল হক

4491

Published on মার্চ 22, 2018
  • Details Image

১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করেছিল গাজীপুরের (সেই সময়ের জয়দেবপুর) বীর জনতা। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে লাঠি-ছেনি ও গাদা বন্দুক নিয়ে গর্জে উঠেছিল জয়দেবপুরের জনগণ। একপর্যায়ে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তিনজন বীর বাঙালি। আহত হয়েছিলেন শত শত স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ। জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে অবস্থানরত দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করা হচ্ছে— এমন সংবাদ পেয়ে হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা সেদিন জয়দেবপুরের রেলপথ ও রাজপথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। কোথাও রেললাইন তুলে ফেলে, রেলগেটে মালগাড়ির বগিসহ অকেজো রেললাইনের স্লিপার ও বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে; যাতে পাকিস্তানি বাহিনী কোনো অস্ত্র নিয়ে ঢাকায় ফেরত যেতে না পারে। তখন জয়দেবপুরে নিয়োজিত দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। পরে তিনি বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি হন। আমরা যখন ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম তখন টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে সেনাবাহিনীর একটি কনভয় জয়দেবপুর আসছিল। জনতা রেশনের গাড়িটি আটকে দেয় এবং কনভয়ে থাকা পাঁচজন সৈন্যের চাইনিজ রাইফেল ও গুলি কেড়ে নেয়। এদিকে রেলগেটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব আদেশ দেন। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে ঠেলে দিয়ে পেছনে রাখা হয় পাঞ্জাবি সৈন্যদের। একপর্যায়ে মেজর সফিউল্লাহকে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা বাঙালি জনতার ওপর গুলিবর্ষণ না করে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সামনে এগোতে থাকে। আমরা বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে পেছনে অবস্থান নেওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করি। এ পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে প্রথম শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা। আহত হন সন্তোষ, ডা. ইউসুফসহ কয়েক শ মানুষ। পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করলে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। এরপর ব্রিগেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে সড়কপথের ব্যারিকেড পরিষ্কার করতে করতে চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার জনতার প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এখানে নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত আলী এক পাঞ্জাবি সৈন্যকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করে তার অস্ত্র কেড়ে নেন। আমরাও সৈন্যদের রাইফেল কেড়ে নিই। কিন্তু পেছনের এক পাঞ্জাবি সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করে। হুরমত সেখানেই শাহাদাতবরণ করেন। বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গি’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে। ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধের খবর দ্রুত দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সারা দেশে স্লোগান ওঠে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর-সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর’। মনে পড়ে মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। জয়দেবপুরে আমার পরামর্শে ২ মার্চ রাতে তৎকালীন থানা পশুপালন কর্মকর্তা আহম্মেদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব উল্লাহ এক সর্বদলীয় সভা আহ্বান করেন। সভায় আমাকে (আ ক ম মোজাম্মেল হক) আহ্বায়ক ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির শ্রমিকনেতা নজরুল ইসলাম খানকে (বর্তমানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য) কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ৩ মার্চ জয়দেবপুরে এই সর্বদলীয় পরিষদের উদ্যোগে গাজীপুর স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের বটতলায় এক সমাবেশ করে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৭ মার্চ জয়দেবপুর থেকে হাজার হাজার মানুষ ট্রেনে এবং শতাধিক ট্রাক ও বাসে করে মাথায় লাল ফিতা বেঁধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় যোগ দিয়েছিলাম।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

সৌজন্যেঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত