7432
Published on মার্চ 24, 2019'ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তের একটি কর্দমাক্ত শহর বারাসাত। এর স্বাভাবিক জনসংখ্যা ২১ হাজার। এশীয় মানদণ্ডে বিচার করলে এখানকার হাসপাতালটি কোনোরকমে এই অধিবাসীদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে পারে। গত সপ্তাহে দেড়-দুই লাখ লোক বানের জলের মতো বারাসাত শহরে ঢুকে পড়েছে। তারা শহরের চারদিকে ধানি জমিতে গিজগিজ করছে। স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল এবং পতিত জমিতে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।'
ব্রিটেনের 'সানডে টাইমস' ১৯৭১ সালের ১৩ জুন 'দুঃখের মিছিল' শিরোনামে বাংলাদেশি শরণার্থীদের মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেছিল। এই চিত্রটা শুধু বারাসাতেরই নয়- 'শরণার্থী ৭১' বইয়ের লেখক সুখেন্দু সেন শরণার্থী শিবিরগুলোর বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন, 'শরণার্থী শিবিরগুলো যেন সীমান্তজুড়ে একেকটি বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছিল।' মূলত নিজেদের শরণার্থী জীবনের স্মৃতিচারণমূলক বইটিতে তিনি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের অনেক শিবিরের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, 'বন্যার আগাম আভাস পেয়ে গাছ বেয়ে ওঠা পিঁপড়ের সারির মতো, দুর্গম পথ, নদী-খাল, বন-বাদাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভবিষ্যতের আশঙ্কা সঙ্গী করে ক্রমাগত পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের তেরশ' মাইল সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থীরা ভারতে ঢুকছে। প্রথমে স্কুল, কলেজ, রেলস্টেশন, পরিত্যক্ত বাড়ি-আঙিনা, সরকারি স্থাপনা, হাটবাজারের চালা, খালি গুদামঘরের আশ্রয়। ক্রমে বাঁশ আর উপরে ত্রিপল টেনে সারি সারি খুপরি।'
১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় 'অক্সফাম' সেই বছর অক্টোবর মাসে 'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি' নামে যে প্রচারপত্র প্রকাশ করেছিল, তাতে নরওয়েজিয়ান চার্চ রিলিফের রলফ র্যাঞ্জ লিখেছিলেন, 'মানুষের অন্তহীন এক স্রোত। এরা সব শরণার্থী। আমরা ৫০০ গরুর গাড়ি গুনলাম। গাড়ির দুই পাশে হেঁটে চলা মানুষ। তারা দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করছে। হাত ওপরে তুলছে এবং চিৎকার করতে শুরু করেছে। মনে হলো, তাদের দুরবস্থার কথা আমাদের জানাতে তারা উদগ্রীব। কয়েকজন দৌড়ে আমাদের কাছে এসে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে আঙ্গুল তুলে বলতে শুরু করল। যদিও আমরা কেউ বাংলাভাষী নই, তবুও তাদের কথা বুঝতে আমাদের সমসা্য হলো না। যে গ্রাম ছেড়ে তারা আসতে বাধ্য হয়েছে তা আগুনে পুড়ছে। সাদা চুলের একজন বুড়ো মানুষ আকাশের দিকে হাত তুলে কেঁদে উঠল। অঙ্গভঙ্গিতে আমাদের জানাল, তার আটটি সন্তানের সব কয়টি নিহত হয়েছে।'
শরণার্থীরা কেন ভারতে আসছে, কেন পালাচ্ছে নিজের বাসভূমি থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৭১ সালের ২ আগস্টের সংখ্যায় লেখা হয়েছিল, 'সম্ভবত যে অবস্থা থেকে তারা পালিয়ে এসেছে তা এর চেয়েও খারাপ। এক দম্পতি আমাদের জানিয়েছেন, কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের দুই তরুণ ছেলেকে ঘরের বাইরে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে তলপেট ফেড়ে ফেলে।' ওই প্রতিবেদনে এই কথাগুলো লেখার আগেই শিবিরের একটা বিবরণ দেওয়া হয়েছিল এবং পরে এর চেয়েও খারাপের তুলনাটা দেওয়া হয়। শরণার্থী শিবিরের বর্ণনায় প্রতিবেদক লেখেন, 'বেশির ভাগ শরণার্থী শিবির পরিণত হয়েছে সামুদ্রিক দ্বীপে।'
'সামুদ্রিক দ্বীপে'র মতো শিবিরগুলো তৈরি হওয়ার একটা বিবরণ পাওয়া যায় সুখেন্দু সেনের 'শরণার্থী ৭১' বইয়ে- 'পুলিশ স্টেশন, বিএসএফ ফাঁড়ি, পোস্ট অফিস, পিডাব্লিউডির সাবডিভিশন এ নিয়েই এতদিন একইভাবে চলে আসা বালাট যেন দ্রুত বদলে যেতে লাগল। পাহাড়ি জনপদের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ করেই সৃষ্টি হলো চাঞ্চল্য। সরকারি লোকেরা সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত। নাম রেজিস্ট্রেশন, পরিবারপিছু রেশন কার্ড আরও কত উটকো ঝামেলা।' সুখেন্দুদের পরিবারটি প্রথমে এই বালাটে আশ্রয় নিয়েছিল, সেটা একাত্তরের এপ্রিল মাসের কথা। সুখেন্দু সেনের বর্ণনায়- 'বিরল বসতির বালাট এবং আশেপাশের তিন-চার মাইল পর্যন্ত এ অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীর সংখ্যা দুই-তিন হাজারের মতো। কিন্তু শরণার্থীর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রকৃতির সবুজ অরণ্য ছাপিয়ে বালাট পরিণত হলো জনারণ্যে। মৈলাম, পানছড়া, লালপানি তখন অপেক্ষা করে আছে আরও কয়েক লক্ষ শরণার্থীর।'
মৈলামের শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কাটাতে হয়েছিল সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সৌরভ ভূষণ দেবের পরিবারকে। তখন সৌরভের বয়স ছিল ৯ বছর। ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা যারা শরণার্থী জীবনের দুঃসহ সময় পেরিয়ে এসেছি, তারা ছাড়া আর কারও পক্ষে এমন অমানবিক উদ্বাস্তু জীবনের কষ্ট অনুভব করা সম্ভব নয়। দেশে আমার বাবা মোটামুটি সম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। সুনামগঞ্জ আক্রান্ত হলে শহরের বাসা ছাড়তে হয় এক বস্ত্রে। মা বোঁচকার মধ্যে নিজের স্বর্ণালঙ্কারগুলো নিতে পেরেছিলেন। দেশের ভেতর বিভিন্ন গ্রামে মাস দেড়েকের অজ্ঞাতবাস শেষে মে মাসে সীমান্ত অতিক্রম করি। কেওড়া পাতার ছাউনি বেড়ার ব্যারাক টাইপ শিবিরের একটি ঘর কপালে জোটে। বালুপ্রান্তরে নির্মিত ব্যারাক। বালুতেই শয্যা। এই সুখও কি কপালে সয়? আগুন লাগে ক্যাম্পে, একবার নয় দুই দুইবার। মায়ের যক্ষের ধন স্বর্ণালঙ্কার আগুনের ভোগে চলে যায়। স্বাধীনতার পর নিঃস্ব- রিক্ত আমরা যখন স্বদেশে ফিরে আসলাম, তখন মেরুদণ্ড ভাঙা প্রাণী। এরপর থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যহীন দৌড়ের মধ্যেই আছি।'
কুড়িগ্রামের সাংবাদিক পরিমল মজুমদারের কাছে শরণার্থী শিবিরের দুঃখকষ্টের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'শরণার্থী জীবনের সবটাই দুঃখের। মাঝে মধ্যে যখন মাইকে দেশের গান বাজত, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতাম, তখন এগুলো সঞ্জীবনী সুধার মতো কাজ করত, মনে হতো দেশ একদিন স্বাধীন হবে। আবার আমরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে যাব।' একাত্তরে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র পরিমল বলেন, 'ত্রাণের লাইনে দাঁড়ানো থেকে শিবিরের সবকিছুই ছিল গভীর বেদনার। বৃষ্টিতে ভিজেছি, রোদে পুড়েছি। হয়তো এমন হলো- কোনো রকমে একদিন একটু মাংস জোগাড় হলো। সেই মাংস-ভাত খাওয়ার সময় পাশের খুপরির কারোর তাকিয়ে থাকা মর্মমূলে গিয়ে লেগেছে। শিবির থেকে শরীরে যে চর্মরোগ নিয়ে ফিরেছিলাম, তা পরেও অনেকদিন ভুগিয়েছে।'
শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রিতদের রোগশোক নিত্যসঙ্গী ছিল বলে জানালেন মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস। মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্সফামের পক্ষে ৫০টির বেশি শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়ক জুলিয়ান ফ্রান্সিস সমকালের সঙ্গে আলাপে বলেন, '১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস, শীত তখন আসি আসি করছে, আমাদের প্রয়োজন ছিল কম্বল ও গরম কাপড়। আমরা হিসাব কষছিলাম, আগামী মাসগুলোতে শরণার্থীদের সহায়তায় আমাদের কতটা অর্থ ব্যয় হতে পারে। অক্সফাম তখন ব্যাপকভাবে তহবিল সংগ্রহের জন্য দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি (ষাটজনের সাক্ষ্য) প্রকাশের পরিকল্পনা করে, যেখানে মাদার তেরেসা, সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিসহ ৬০ জন মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে গণহত্যা থামাবার আবেদন করেছিলেন।'
'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি'তে ষাটজনের একজন হিসেবে জুলিয়ান ফ্রান্সিস লিখেছিলেন, 'অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে পরিবারগুলো ভিজে জবুথবু, তাদের মাঝে কাপড় শুকানোর দড়ি ছাড়া দুটি পরিবারকে আলাদা করার মতো কোনো দেয়াল নেই। খড়ের তৈরি ছাউনি বৃষ্টির কাছে অসহায়, মাটির বিছানা ভিজে একাকার। প্রতিনিয়ত কুটিরগুলো থেকে শত শত শরণার্থী সরকারি রেশনের জন্য লাইন ধরছে, পানি ও পয়ঃনিস্কাশনের জন্য তাদের সারিও চোখে পড়ার মতো। আমাশয়ে আক্রান্তরা খুব কমই নিজেদের ধরে রাখতে পারছে। শিশুরাও তাদের বিশেষ পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।' ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর 'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি' যখন প্রকাশিত হয়, তখন পর্যন্ত ভারতে আশ্রিত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ, যা পরে ১৫ ডিসেম্বরে গিয়ে ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন হয়েছিল। 'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি'তে জুলিয়ান আরও লিখেছিলেন, 'এই হচ্ছে ৯০ লাখ শরণার্থীর জীবনচিত্র। যাদের কোনো কাজ ছিল না, ছিল না পয়সাকড়িও। তবে তারা জানত, কেন তারা এসেছে। তারা এ-ও জানত, এ জায়গাটাই তাদের জন্য নিরাপদ। জীবন বাঁচানোর জন্য এখানে আসা ছাড়া যে গত্যন্তর নেই।'
মানুষের মতো পাখিরাও অনিরাপদ হয়ে পড়েছিল যুদ্ধের ৯ মাস। মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক আবু সাঈদ খান তার 'ফিরে দেখা একাত্তর' বইয়ে লিখেছেন, 'কোন এক পত্রিকার শিরোনাম, শরণার্থী পাখি! প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে এসেছে। এবার পার্কগুলোতে তাই অন্য বছরের তুলনায় অতিথি পাখির সংখ্যা বেশি। গোলাগুলির শব্দে পাখিরাও বাংলাদেশ ছেড়ে এখানে চলে এসেছে। দেশে ফেরার পর এর সত্যতা মিলল। শুনলাম একাত্তরে বিলে-ঝিলে, বনেবাদাড়ে খুব বেশি অতিথি পাখি দেখা যায়নি, তবে নিত্য আনাগোনা ছিল শকুনের।'