6483
Published on মার্চ 14, 2018বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্নে ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে কোন কোন বক্তৃতা স্থান ও সময়কে অতিক্রম করে কালজয়ী হয়ে থাকে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নবেম্বর গেটিসবার্গে দেয়া আব্রাহাম লিংকনের বক্তৃতা, ১৮১৪ সালের ২০ এপ্রিল ইম্পেরিয়াল গার্ড রেজিমেন্টের উদ্দেশে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ভাষণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দেয়া উইনস্টন চার্চিলের কয়েকটি ভাষণ, ১৯৪০ সালের ১৮ জুন ফরাসীবাসীর উদ্দেশে দেয়া চার্লস দ্য গলের ভাষণ, ১৯২২ সালের ১৮ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনকালে গ্রেফতারের পর আহমেদাবাদে সি এন ব্রুমফিল্ডের আদালতে দেয়া মহাত্মা গান্ধীর জবানবন্দীর বক্তব্য, ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যদের উদ্দেশে দেয়া নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বক্তৃতা, ভারত বিভাগের প্রথম প্রহরে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া জওহরলাল নেহরুর বক্তৃতা, ১৯৬৪ সালের ২০ এপ্রিল আদালতে দেয়া নেলসন ম্যান্ডেলার জবানবন্দী, ১৯৬৮ সালের ৩ এপ্রিল নাগরিক অধিকার সম্পর্কে দেয়া মার্টিন লুথার কিং এর বক্তৃতা অন্যতম। ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এ সকল বক্তৃতা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা-এর মধ্যে সবচেয়ে প্রধান, যা বিশ্বের সবচেয়ে বহুল পঠিত এবং বহুল উদ্ধৃত বক্তৃতা।
আব্রহাম লিংকন ছিলেন আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট। ১৮৬১ সালের ৪ মার্চ থেকে ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আব্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গের বক্তৃতা প্রদান করেন যখন আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধে নিহত আমেরিকান সৈন্যদের যেখানে সমাহিত করা হয়েছিল সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি তার এই ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন। বক্তৃতাটি ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। জনসভার জন্য লিংকন আগের দিন একটি লিখিত বক্তৃতা তৈরি করেন যেটি তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাত্র দুই মিনিটে সমাপ্ত ভাষণে মোট ১০টি বাক্য এবং ২৭২টি শব্দ ছিল।
মজার কথা, সে দিনের সেই সভায় আব্রাহাম লিংকনের বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল না। সভার মূল বক্তা ছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত ও সবচেয়ে জনপ্রিয় বক্তা এ্যাডওয়ার্ড এভারেস্ট। লিংকনের পূর্বে তিনি দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার এই বক্তৃতা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়নি। স্মরণীয় হয়ে আছে আব্রাহাম লিংকনের দুই মিনিটের বক্তৃতা। এভারেস্টের দীর্ঘ বক্তৃতার পর জনতা তুমুল করতালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দিত করলেও লিংকনের বক্তৃতার পর তারা ছিল নিশ্চুপ। প্রকৃতপক্ষে বক্তৃতাটি এত সংক্ষিপ্ত ছিল যে, শ্রোতারা বুঝে ওঠার আগেই তা সমাপ্ত হয়। এমনকি সংক্ষিপ্ততার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত এই ভাষণের কোন ছবি তোলাও সম্ভব হয়নি। সভার জন্য আগের দিন লিংকন তার বক্তৃতার বেশ কয়েকটি খসড়া তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে তিনি তার বক্তৃতার সময় পূর্বে তৈরিকৃত ভাষণের দিকে একবারের জন্যও ফিরে তাকাননি। তার সম্পূর্ণ বক্তৃতাটিই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
আর বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ছিল অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ। তখনকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান ছিল সেদিনের গেটিসবাগের্র সমতুল্য। বাঙালীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল ৭ মার্চ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের পনেরো কোটি কর্ণ সেদিন সজাগ ছিল বঙ্গবন্ধু কি বলেন তা শোনার জন্য। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার পিতার সঙ্গে সেদিনের জনসভায় উপস্থিত থাকার। সেদিন জনতার মধ্যে কি আবেগ, উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা ছিল, কোন ভাষা দিয়েই এখনকার প্রজন্মকে তা বুঝানো যাবে না।
গেটিসবার্গের বক্তৃতার মতই এটিও ছিল মাত্র ১৮ মিনিটের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতাটি নিয়ে অনেকেই বিগত ৪৬ বছর নানাভাবে বিভিন্ন রকম আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। পাকিস্তানী শাসন শোষণের ইতিহাস, সৃষ্ট সঙ্কটের কারণ, সঙ্কট সমাধানের বিভিন্ন পথ, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অনুরোধ থেকে হুঁশিয়ারি, রাজনৈতিক সমাধান না হলে জনগণের কর্তব্য, এমন কি আসন্ন যুদ্ধের জন্য সকলকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান ইত্যাদি এমন কোন বিষয় ছিল না যা সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উল্লেখ ছিল না। যাদেরকে হুঁশিয়ারি করে বলেছিলেন ‘আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো’, তাদের উদ্দেশ করেই আবার বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না’। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতায় স্ববিরোধিতার অভিযোগ করেন। আসলে একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের পক্ষেই সম্ভব সব দিক বিবেচনা করে এ ধরনের একটি ভাষণ দেয়া। সেদিন বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই ছিল একেকটি স্ফুলিঙ্গ। পুরো বক্তৃতাটিই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, লিখিত নয়। মনে হচ্ছিল কথাগুলো বের হচ্ছে তার হৃদয় থেকে, শুধু কন্ঠ থেকে নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে উচ্ছ্বসিয়া উঠে।’
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত এই কথার মাধ্যমে সারা দেশবাসীকে চূড়ান্ত সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয়েছিল। নিঃসন্দেহে তাঁর বক্তৃতার এই লাইনটি ছিল সেদিনের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাঁর আরেকটি কথা যা আগামীতে অনাদিকাল পর্যন্ত সকল অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করবে তা হচ্ছে, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আর আমাদের দমাতে পারবে না।’
তিন তিনবার পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত মার্কিন কবি, লেখক ও সাংবাদিক কাল স্যান্ডবার্গ লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতাকে অভিহিত করেছেন “এৎবধঃ অসবৎরপধহ চড়বস” হিসেবে। আর বাংলাদেশের কবি নির্মলেন্দু গুণ রাজনীতির আর এক কবি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বর্ণনা করেছেন এভাবে :
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জন সমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
লেখক : প্রকৌশলী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ
প্রকাশঃ ১২ মার্চ, ২০১৮