2807
Published on মার্চ 14, 2018১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। তৎকালীন যোগাযোগ ও তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ার কারণে ঢাকার বাইরের কিছু কিছু এলাকার মানুষ প্রথম দিকে গণহত্যার মাত্রা সম্বন্ধে সঠিক তথ্য জানতে পারেননি।
২৫ মার্চ বিকেল থেকেই খুলনা শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এলাকার মানুষ বুঝতে পারছিলেন, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। রাত ১২টার দিকে একটা জিপে চড়ে খুলনার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা যখন শহরে টহল দিচ্ছিলেন তখন তারা জানতে পারেন, ঢাকায় প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়েছে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে।
২৬ মার্চ মধ্যরাত থেকে খুলনা শহরে ৭২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। পাকিস্তান সামরিকবাহিনীর সদস্যরা মাইকের মাধ্যমে ঘোষণা দেয় যে, কারফিউ বলবৎ থাকার সময় রাস্তায় কেউ বের হলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ২৬ মার্চ থেকেই খুলনাতেও নিরীহ বাঙালিদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। ২৭ মার্চ কিছু সময়ের জন্য কারফিউ শিথিল করা হলে খুলনার অনেক মানুষ শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করেন।
১৯৭১ সালে খুলনা রেলওয়ে ওয়ার্কশপের লোকোশেডে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা চালায়। ওই ওয়ার্কশপের অনেক বাঙালিকে বিভিন্ন সময় ধরে নিয়ে রেলওয়ে ওয়ার্কশপের ফার্নেস ও বয়লারে ফেলে অমানবিকভাবে হত্যা করা হতো। ওই নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন খুলনা রেলওয়ে ওয়ার্কশপের ফায়ারম্যান (৬ সন্তানের জনক, ৪০ বছর বয়সী) নুরুল হক। তার বাড়ি ছিল নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানায়। সৎ ও কর্মঠ হিসেবে তিনি সবার প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং ওয়ার্কশপসহ এলাকার জনগণ তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। তিনি একজন নেতৃস্থানীয় বাঙালি ছিলেন বলেই রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ও আশপাশের এলাকার অবাঙালিরা তাকে সুনজরে দেখত না।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ নুরুল হক এবং আরো ২১/২২ জনকে রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাদের কেউ সেখান থেকে আর বাইরে বের হয়ে আসতে পারেননি। পরবর্তীকালে জানা যায় যে, তাদের সবাইকে ওই লোকোশেডে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে।
নুরুল হকের বাসার সামনে একটি হোটেল ছিল। সেই হোটেলে বসে নুরুল হকের দুই সন্তান জানতে পারেন যে, নির্মমভাবে তাদের পিতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং পিতার সঙ্গে অন্য যাদের রেলওয়ে ওয়ার্কশপে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের সবাইকেও হত্যা করা হয়েছে। অবাঙালিরা কেবল তাদের পিতাকে হত্যাই করেনি, পরবর্তীকালে তাদের বাসায় গিয়ে অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র লুটপাট করে নিয়ে যায় এবং ব্যাংক ও ইনসিওরেন্সের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে সব নষ্ট করে ফেলে। আর যে সব জিনিসপত্র তারা নিতে পারেনি সেগুলো ভাঙচুর করে রেখে যায়।
ওই সময়ে লোকোশেডের অভ্যন্তরে অবাঙালি ছাড়া কোনো বাঙালির প্রবেশাধিকার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময়ে খুলনা রেলওয়ের বহু বাঙালি কর্মচারী, এলাকাবাসী ও নিরীহ বাঙালিদের ধরে নিয়ে রেলওয়ে ওয়ার্কশপের লোকোশেডের বয়লারে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারা হয়। তবে কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা আজো জানা যায়নি। রেলওয়ে ওয়ার্কশপের লোকোশেডের কাছে পানির ট্যাংক নামক একটি জায়গা আছে। অবাঙালিরা সেখানেও অনেক নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে পশুর মতো জবাই করত। ওই সময়ে অবাঙালিরা জায়গাটার নাম দিয়েছিল বাঙালি কসাইখানা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য লোকোশেডের অভ্যন্তরে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে এই গণহত্যার তথ্য ও শহীদদের নামের তালিকা লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
লেখকঃ লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত
সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ
প্রকাশঃ ১৩ মার্চ, ২০১৮