6546
Published on মার্চ 14, 2018১৯৭১ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় ভাগে আগরতলা পৌঁছাই বিলোনিয়া হয়ে। ফজলুল হক মনির সঙ্গে দেখা শ্রীধর ভিলায়। মনি ভাই বললেন, আবার দেশে যেতে হবে। কী কারণে আসতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। তত দিনে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়ে গেছে। আমি দিন কয়েক বিশ্রাম নিলাম।
প্রবাসী সরকার দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি প্রচারপত্র ছেপেছে। ফজলুল হক মনি বললেন, প্রচারপত্র দেশের ভেতর বিলি করতে হবে। এ ছাড়া দেশের ভেতরে এখনো ছাত্র-তরুণ যারা আছে তাদের ভারতে নিয়ে যেতে হবে। আরেকটি কাজ হলো প্রশিক্ষণ নিয়ে যোদ্ধারা নিরাপদে যাতে আগরতলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসতে পারে সে জন্য একাধিক রুটের সন্ধান করা। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিশেষ করে চৈনিক ধারার বাম সংগঠনগুলো দেশে কী অবস্থান নিয়েছে তার খোঁজ নিয়ে ফিরতে হবে। নেতার নির্দেশ শিরোধার্য করে ফিরে এলাম। এভাবে আগরতলা থেকে ঢাকা ছয়বার যাওয়া-আসা করেছি, জীবনকে হাতের মঠোয় নিয়ে। ফিরে গিয়ে নেতাকে রিপোর্ট করেছি। সেখানে আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখনসহ আরো নেতারা ছিলেন।
একটু আগে ফিরতে চাই। ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের ঢেউটা কিন্তু স্কুলের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল। চট্টগ্রামে স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ হয়েছিল। আমি ছিলাম সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীকালে অভিনেতা ছদরুল পাশা ছিলেন সভাপতি। ১৯৭০ সালে ভর্তি হই জগন্নাথ কলেজে। আমার মামাতো ভাই কে বি এম মফিজুর রহমান ছিলেন কলেজে ছাত্রলীগের নেতা। সে কারণে দ্রুততম সময়ে কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে যাই। জিএস প্রার্থী হই। অবশ্য নির্বাচনটা হয়নি। সে সময় পুরান ঢাকার রুচিয়া রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক অরাজনৈতিক একটি গ্রুপ পুরান ঢাকার কলেজ রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করত। এদের বেশির ভাগের সঙ্গে আবদুর রাজ্জাকের ভালো সম্পর্কের কারণে তারা ছাত্রলীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, যদিও সে সময় পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনএসএফের প্রাধান্য ছিল।
আবার ভারতে অবস্থানকালীন প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ২৮ মে আগরতলা থেকে ভারতীয় সেনাদের কার্গো বিমানে গেলাম দেরাদুন। নামতে হলো শাহরানপুর বিমানঘাঁটিতে। সেখান থেকে পাহাড়ের চূড়ায় টান্ডুয়া ক্যাম্প দেখা যায়। দেখলে মনে এই তো কাছেই। তবে পাহাড় ঘুরে ঘুরে সেনা জিপে উঠতে সময় লেগে গেল ৬ ঘণ্টা।
আমরা ছিলাম তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণার্থী। কমান্ডার ছিলেন কলাবাগানের রাজু ভাই। প্রশিক্ষণ শেষে দক্ষতা দেখে আমাদের কয়েকজনকে রেখে দেওয়া হলো পরবর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষক হিসেবে। আমরা ছিলাম জুনিয়র প্রশিক্ষক। হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া এঁরা ছিলেন সিনিয়র। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বগুড়ার হেদায়েতউল্লাহ টিপু, ডা. ফারুক, কুমিল্লার তোফায়েল, দিনাজপুরের আবদুর রহিম ও জয়ন্ত, মানিকগঞ্জের আবদুল আজিজ, টঙ্গীর কুতুবউদ্দিন ও সিলেটের মোহন।
প্রশিক্ষণকালে মুজিব বাহিনীর চার নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা তুলে ধরতেন বিশেষ করে দুটি গেরিলা যুদ্ধের উদাহরণ, কৌশল। ভিয়েতনাম ও কিউবার যুদ্ধ। বলা হতো চে গুয়েভারার কথা। সত্যি কথা বলতে কী, নিজেকে চে গুয়েভারা ভাবতে শুরু করলাম। আমি একা নই, সবাই যারা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে গেছে—আমরা সর্বান্তকরণে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণের শুরুতে মুজিব বাহিনীর চার নেতা বঙ্গবন্ধুর ছবি সামনে রেখে আমাদের উদ্দেশে বক্তব্য দিতেন। পরবর্তীকালে প্রতিদিন প্রশিক্ষণের শুরুতে আমরা এটা করেছি।
প্রশিক্ষণের সময় আমাদের শেখানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রত্যেককে ভালো যোদ্ধা হতে হবে। ভালো প্রশিক্ষণ নিতে হবে। যুদ্ধে পাকিস্তানিদের হারিয়ে জিততে পারলে আমরা এক সঙ্গে স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু দুটিই পাব। যুদ্ধে হেরে গেলে স্বাধীনতাও যাবে আবার পরাজিত জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুকেও ওরা কোনোভাবেই ফেরত দেবে না। আসলে গোটা মুক্তিযুদ্ধে একটিই ছিল জাদুকরী শব্দ—তা হলো বঙ্গবন্ধু। দেখেছি প্রতিটি যোদ্ধা বিশ্বাস করতেন—আমার জীবনের বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা আসে, বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন তাহলে, জীবন দিতে দ্বিধা নেই। আমাদের ক্যাম্পে বঙ্গবন্ধুর বড় আকারের একটি ছবি টাঙানো ছিল, দেখেছি জেনারেল সুজন সিং উবান ক্যাম্পে এসেই সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুর ছবিকে স্যালুট করতেন। কেবল এটাই নয়, আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর মেজো ছেলে শেখ জামাল ও বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই শেখ মারুফকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার। সে সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেখ জামালকে দেখতে আসতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে অনেকে শেখ জামালকে স্যালুট করতেন।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ে। সকালে প্রশিক্ষণ শুরু করেছি। কমান্ড দেওয়ার আওয়াজটা বেশ জোরে হয়েছে। কয়েক মিনিট পর বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা অফিসার নিয়ে সেখানে এলেন জেনারেল উবান। আমাকে বললেন, ‘তুমি আবার কমান্ড দাও তো।’ দিলাম। এবার ভারতীয় সেনাদের দিকে তাকিয়ে উবান বলতে লাগলেন, ‘দ্যাখো তোমরা যে কমান্ড দাও সেটা বেতনের বিনিময়ে, সে কারণে জোর কম। আর এই বাচ্চা ছেলে এত জোরে কমান্ড দিতে পেরেছে, এটা দেশপ্রেমের জোর। তবে শোন, আমি বলে যাচ্ছি, যাদের অন্তরে এত দেশপ্রেম তাদের স্বাধীনতা ঠেকানোর শক্তি দুনিয়ার কারো নেই।’
লেখক : ১৯৭১ সালে ছাত্রলীগ জগন্নাথ কলেজের নেতা ছিলেন। দেরাদুনের টান্ডুয়া ক্যাম্পের প্রশিক্ষক। ডাকসুর দুবারের জিএস, একবার ভিপি। সাবেক এমপি। বর্তমানে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ
প্রকাশঃ ১৩ মার্চ ২০১৮