4813
Published on মার্চ 14, 2018১৯৭১ সালে মার্চ মাসটি ছিল আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাস। এই মাসটিতে আমরা বাঙালিরা একত্রিত হয়ে প্রমাণ করেছিলাম– আমরা বাঙালি, আমরা বীরের জাতি। যে আহবানটি আমাদের জানিয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে এবং সেই আহবানেই সারা দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।
২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে কয়েকজন বীর শব্দসৈনিক স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র শুরু করেন। সেটিও আবার ৩০শে মার্চ পর্যন্ত চালু থেকে পাকিস্তানি বিমান আক্রমণে আবার বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ২৫শে মে সকালে ৫০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার মারফত ইথারে ধ্বনিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার এর দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান। এই বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আব্দুল মান্নান এমএনএর উপর। দৈনিক সকাল ৭টায় ও সন্ধ্যা ৭টায় দুই অধিবেশনে অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো । মূলত: বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ “বজ্রকণ্ঠ ও বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গান প্রচার শুরু হয়। যার সঙ্গে প্রথম যে দশজন সাহসিকতার সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার শুরু করেন তারা হলেন বেলাল মোহাম্মদ, রাশেদুল হাসান, আমিনুর রহমান, শারফুজ্জামান, মুস্তফা আনোয়ার, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, রেজাউল করিম চৌধুরী, কাজী হাবিব উদ্দিন এবং সৈয়দ আব্দুস শাকের। এর মধ্যে একে একে স্বাধীন বাংলা বেতার যোগ দেন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনায় বেতার কর্মী ছাড়াও বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবীদ সহ প্রায় ২৫০ জনের ও শব্দসৈনিক স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দেন। এই বেতার কেন্দ্রটি ছিল বলিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮ নম্বর দ্বিতল বাড়িতে। ১৯৭১ এর মে মাসে আমি আগরতলার কলেজ টিলাতে কিছুদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পর জুন মাসের প্রথম দিকে পৌঁছে যাই কোলকাতা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে একটি বেতার কেন্দ্র যুদ্ধ পরিচালনা , সহযোগিতা, উত্সাহ ও উদ্দীপনায়, এমন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পেরেছে । প্রতিটি পরিবার তখন রাতে ঘর অন্ধকার করে বালিশের নীচে ট্রানজিস্টারটি রেখে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনত। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলাদের বিজয় সংবাদ পরিবেশিত হতো, জানানো হতো কত জন রাজাকার, কিংবা পাক বাহিনী হত্যা করা হয়েছে। অথবা কোন ব্রিজটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব তাজা সংবাদই ছিল মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মূল প্রেরণা। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যুদ্ধের অন্যান্য সেক্টরের মতো ছিল আর একটি সেক্টর। যে সেক্টরটি থেকে যুদ্ধের সংবাদ ও উদ্দীপনামূলক গান, নাটিকা, বজ্রকণ্ঠ প্রচার না হলে হয়ত যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হতো। স্বাধীন বাংলা বেতারে আমরা ছিলাম একটি পরিবারের মতো । কোনদিন খাইনি, কোনো দিন ঘুমাইনি, সারারাত গান করেছি, তবুও কষ্ট হয়নি। শুধু স্বপ্ন দেখেছি একটি স্বাধীন দেশের। অবশেষে সকল কষ্টের অবসান হলো ১৬ই ডিসেম্বর । আমাদের বিজয় সূচীত হলো, দেশে ফিরলাম, বুক ফুলিয়ে এখন বলতে পারি আমি একজন শব্দসৈনিক।
লেখক: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত
সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক
প্রকাশঃ ১৩ মার্চ, ২০১৮