15792
Published on মার্চ 13, 2018কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো নৌকায় করে আগরতলা পৌঁছাই ২০ এপ্রিল। তখন সন্ধ্যা। আমার সঙ্গে রূপগঞ্জের মহিউদ্দিন মিলন। রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। পরদিন দেখা সে সময়ের ছাত্র নেতা সৈয়দ রেজাউর রহমানের সঙ্গে। জানতে চাইলাম শেখ ফজলুল হক মনি কোথায় আছেন, কিভাবে তাঁকে পাই। তিনি শ্রীধর ভিলার ঠিকানা দিলেন। গিয়ে মনি ভাইকে পেলাম। সেখানে আরো ছিলেন আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, এম এ রশিদ ও রাজিউদ্দিন রাজু।
সবার আগে শেখ ফজলুল হক মনিকে খোঁজার একটি কারণ আছে, সেটা বলা দরকার। ১৯৬৫ সালে আমি গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হই। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসতে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের চাপাচাপি থাকলেও মনি ভাইর অনুপ্রেরণায় টঙ্গীতে শ্রমিক রাজনীতি শুরু করি। টঙ্গীর শ্রমিক রাজনীতিতে তখন কাজী জাফরের ব্যাপক প্রভাব। তিনি আওয়ামী লীগবিরোধী কট্টর চৈনিক ধারার নেতা। বঙ্গবন্ধু একদিন বললেন, ‘মোজাম্মেল টঙ্গীতে আমাদের শ্রমিক ফ্রন্ট অত শক্ত নয়, তোদের কাজী পরিবারের টঙ্গীতে অনেক প্রভাব, তোরা স্থানীয় লোক। শ্রমিক রাজনীতিটা করলে ভালো হয়।’ বঙ্গবন্ধুর কথাটা মনি ভাইকে বলি, তিনিও শ্রমিক রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা দেন। মনি ভাই সহযোগিতা দিতেন।
আগরতলা যাওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছিল বঙ্গবন্ধুর আরো একটা কথা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তোদের টঙ্গীতে নির্জন, নিরাপদ কিছু বাড়ি ঠিক করে রাখবি; যুদ্ধ শুরু হলে এগুলো কাজে লাগবে।’ ভাবছিলাম বঙ্গবন্ধু হয়তো এ যুদ্ধের কথাই বলছিলেন।
ফজলুল হক মনি দায়িত্ব দিলেন ত্রিপুরার ভাদাড়ঘাট ক্যাম্পের। দায়িত্ব রিক্রুটিং। আমাদের এলাকার যেসব ছাত্র-তরুণ পৌঁছেছে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট করা। কাজ করতে থাকলাম। মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়ে গেছে, মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মুক্তি বাহিনী থাকতে আবার একটা মুজিব বাহিনী কেন? এমন একটা কানাঘুষা শোনা যাচ্ছিল। এমন একটা সময়ে প্রবাসী সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী আগরতলা আসেন। তাদের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের বেশ তর্ক-বিতর্ক দেখেছি। তবে আবার এটাও দেখলাম সব মীমাংসা হয়ে গেল। ছাত্র নেতারাও বলতে থাকলেন, তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের সকলের প্রধানমন্ত্রী। গুজবে কান দেওয়ার দরকার নেই। এখন কাজ একটা, তা হলো যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা।
আগরতলা ক্যাম্পে রাজনৈতিক মোটিভেশন হতো। একটি রাজনৈতিক মোটিভেশন ক্যাম্পে বক্তব্য দেন শেখ ফজুলল হক মনি। তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ হলো গণমানুষের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কত দিন চলবে জানি না। যুদ্ধ দীর্ঘদিন চললে, সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে—এমনকি আমাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারে। সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলে যুদ্ধে আমরা নিশ্চিত হেরে যাব। সাধারণ মানুষের সমর্থন ধরে রাখতে হলে অস্ত্রের যুদ্ধের পাশাপাশি রাজনীতির যুদ্ধও চালিয়ে যেতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত যোদ্ধা। সে কারণে আমরা শিক্ষিত ছাত্র-তরুণদের নিয়ে আলাদা বাহিনী করেছি, তাদের অস্ত্র ও রাজনীতি দুটিরই উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি।’
আজও মনে পড়ে মনি ভাই বলছিলেন, ‘কেবল অস্ত্রের জোরে যেমন কোনো জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায় না, ঠিক তেমনি শুধু অস্ত্র দিয়ে কোনো জাতির মুক্তি আনাও সম্ভব নয়। মুক্তির জন্য যেমন অস্ত্রের প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন জনগণের সম্পৃক্ততা। আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে বিপদ। এখানে অস্ত্র-রাজনীতির সঙ্গে জনতার মিলন ঘটাতে হবে। তা হলেই বিজয় সম্ভব। মুক্তি বাহিনী লড়ছে, আমরাও লড়ছি, লক্ষ্য এক; বিরোধ নেই।’
মনি ভাই আমাদের ভিয়েতনামের গেরিলা যুদ্ধের কথা বললেন, চে গুয়েভারার কথা বললেন। কিভাবে গেরিলা যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করব, সে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে সে কথা বললেন। সে দিন ভাবছিলাম, আমাদের ছাত্রনেতারা যুদ্ধ নিয়ে এত ভাবনা কখন ভাবলেন। সে দিন মনি ভাইয়ের কথায় আমাদের সব দ্বিধা কেটে গেল।
দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিতে যাই অক্টোবরে; আগরতলা থেকে ভারতীয় সেনাদের কার্গো বিমানে। আমরা এক সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিই ৮০ জন। এটা ছিল লিডার্স ট্রেনিং। আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা। জেনারেল সুজন সিং উবানকে দেখেছি ক্যাম্পে।
যুদ্ধের সময়ে ভারতে চলাচলের সুবিধার্থে আমাদের মুজিব বাহিনীর চার প্রধান চারটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। শেখ ফজলুল হক মনির নাম ছিল মনা, সিরাজুল আলম খানের নাম সরোজ, আবদুর রাজ্জাকের নাম রাজু এবং তোফায়েল আহমেদের নাম তপন।
প্রশিক্ষণ শেষে দেশে প্রবেশ করি নভেম্বর মাসে। মিত্র বাহিনীর সঙ্গে মিলে ছয়দোনার যুদ্ধে অংশ নিই। এটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
লেখক : ১৯৭১ সালে মুজিব বাহিনী ঢাকা উত্তরের প্রধান ছিলেন, সাবেক সংসদ সদস্য
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ