5203
Published on মার্চ 5, 2018মার্চ মাস এলেই আমরা স্বাধীনতার কথা বলি। এই মাসে আমরা পেয়েছিলাম কালজয়ী এক ভাষণ। জাতির পিতার সেই অমোঘ ভাষণের জন্য আমাদের দেশে যত কথা যত লেখা হোক সেটি এখনও বিদেশে তেমন প্রচার পায়নি। যেভাবে ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া উচিত তাও পায়নি। এর কারণ আমাদের নেতারা সব বিষয়ে করণীয় কাজ করতে চান না। এখন বাংলাদেশের যে উন্নয়ন বিশ্বজুড়ে যে পরিচিত যেভাবে তার কদর বাড়ছে তাতে এই কাজটি করা সময়ের ব্যাপার। আমরা স্বাধীনতার এই মাসে ভুলে যাই নেতাকে আমরা শোকের জন্যও যথেষ্ট সময় দিতে পারিনি। তাঁর প্রতি বিশ্বের মনযোগ কোনদিন না কমলেও আমরা একসময় প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম তাঁকে। অপরাজনীতি অপশক্তি অপইতিহাসে তাঁকে চাপা দেয়ার জঘন্য চক্রান্ত সময় সামাল দিয়েছে। রাজনীতি পারেনি। অথচ দুনিয়ায় তাঁর সম্মানের জায়গাটা সর্বত্র এক ধরনের।
কিউবার নেতার মৃত্যুর পর সেদেশের মানুষ ও রাজনীতি যেভাবে শোকাহত ও শোক পালন করেছে তা থেকে কিছু কি শিখব আমরা? আমাদের জনককে তিনি হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তাঁকে গভীর ভালোবাসতেন তিনি। পথ বাতলে দিয়েছিলেন বিপ্লব বা যুদ্ধের পর কি করতে হয়। নিজের ঘরের বৈরী দমনে কঠোর হবার কথা মানলে জাসদের জন্ম হতো না। জাসদ না হলে জামায়াত তার আড়ালে সংগঠিত হতে পারত না। আর এদেশের ইতিহাসও ভবিষ্যত এমন জায়গায় এসেও দাঁড়াত না। ফিদেল দুনিয়ার সেরা শক্তির নব্বই মাইলের ভিতর থেকেও নিজেকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন। কেউ তাঁর চুল ছিঁড়তে পারেনি। এখন তাদের অতীতও ইতিহাস এত পোক্ত কারো সাধ্য নেই উপড়ে ফেলে। আমরা এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দেখতে চাইব কি আমাদের ভবিষ্যত?
আপনি যখন দিল্লী তখন দুটো জায়গায় আপনাকে যেতেই হবে। একটি তাদের দেশের জনক বাপুজী গান্ধীর সমাধি রাজঘাট। সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর আপনি যাবেন শক্তিস্থল নামে খ্যাত নেহেরুর সমাধি দেখতে। পাশে আছে আরও কিছু মনীষীর স্মারক। এই বিষয়টি খোদ রাজধানীর বুকে হবার কারণে মানুষ একদিকে যেমন ইতিহাসের নায়কদের জানতে পারে, তার সঙ্গে আছে জাতীয় চেতনায় গর্বিত হবার দিকটিও। আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকা। আমাদের ঢাকা নগরী হিসেবে নানা কারণে বিখ্যাত। ভাষা আন্দোলনের মতো কালজয়ী ঘটনার সূতিকাগার। পাকিস্তানের বুক চিরে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের এই রাজধানী একাত্তরের পবিত্র তীর্থভূমি। রক্তস্নাত এই মাটিতে জাতির জনকের ঠাঁই করে দিতে পারিনি আমরা। কূটরাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের ফলে তিনি জায়গা পেয়েছেন ঢাকা থেকে দূরে তাঁর গ্রামের বাড়িতে। এতে তাঁর ভূমিকা গৌরব বা মর্যাদা কিছুই খাটো হয়নি। বরং আমরাই হয়েছি বঞ্চিত।
ঢাকায় আমাদের আরেকটি তীর্থভূমি এককালের রেসকোর্স বা এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিশাল জনসভার গৌরবে উদ্দীপ্ত এই মাঠে আমরা আমাদের স্বাধীনতার মন্ত্র শুনেছিলাম। সেদিনের আবহ আর পরিবেশ না জানলে বোঝা যাবে না কাকে বলে ঐক্য আর কাকে বলে চেতনা। দেশের এমন কোন প্রান্ত নেই যেখান থেকে মানুষ ছুটে আসেনি। সেই মহামিলনের সন্ধ্যাটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের। স্বাধীন দেশ স্বাধীন জাতি শব্দটি শুনতে যত ভাল অর্জন ততটাই কঠিন। সে কঠিন সংগ্রামের সূচনাকারী এই ময়দান আজ নানা কারণে আমাদের হাতে দীর্ন। আমরা এমন এক জাতি আপন গৌরবও ধরে রাখতে পারি না। এত কলহ আর এত মতভেদ অন্য কোন জাতিতে বিরল।
কিসের ইন্ধনে বা কোন ষড়যন্ত্রে এই দুর্দশা? সময় বলে বাংলাদেশের মানুষ ঠিক সময় ঠিক কাজটি করতে জানে। যখন তার প্রয়োজন হয় তখন সে ঠিক রুখে দাঁড়ায়। তাই যদি আজ সত্য মানি জানতে ইচ্ছে হয় সংস্কৃতির গৌরব কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে কেন আমরা এক হতে পারছি না? সেই রবীন্দ্রনাথ সেই নজরুল লালন ফকির হাছন রাজা তো আজও চলমান। আজ আমাদের সংস্কৃতিতে কেন এই নকলের আনাগোনা? কি কারণে কোন কারণে মধ্যপ্রাচ্য বা হিন্দি হয়ে উঠছে নির্ধারক? নতুন প্রজন্মের দিকে তাকালে ভয় হয়। এরা ভাল করে অতীত জানে না। জানে না নিজেদের মাতৃভূমির গৌরবগাঁথা। এদেশের মানুষের ত্যাগ ভালবাসা আর সংস্কৃতির জোর কি তবে ক্রমেই তার শক্তি হারিয়ে ফেলছে? আজকাল পোশাকে খাবারে কথায় জীবন যাপনে ধর্মের নামে এক ধরনের উন্মাদনা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ম ও জীবন এদেশে চিরকাল হাত ধরাধরি করে চলেছে। সঙ্গে পা ফেলেছে সংস্কৃতি। কই কোনদিন তো এত কথা এত ভয় বা এত উত্তেজনা কাজ করেনি। কৈশোরে আমরা দেখেছি অগ্রজরা সেøাগান দিচ্ছেন একেক একটি বাংলা বর্ণমালা একেকজন বাঙালীর জীবন। বাংলাভাষা বাংলা নাম বাংলা প্রীতির সে জোয়ারে ভেসে গেছে যাবতীয় সংকীর্ণতা। সম্ভব হয়েছিল ভাষাভিত্তিক একটি দেশ নির্মাণ। সেটাই তো জতির পরিচয় সূত্র হওয়া উচিত। ধর্মতো নির্ণয় করবে সম্প্রদায়। সে কারণে কোন ধরনের ঝামেলা বা দাঙ্গা বাধলে আমরা বলি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা। আজ এই ডিজিটাল যুগে অগ্রসর সমাজে আমরা কেন তার উল্টোটি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছি?
বলবো এর পেছনে আছে বদলে যাওয়া মধ্যবিত্ত আর সুযোগসন্ধানী রাজনীতি। যখন থেকে সামরিক শাসন সামরিক জান্তারা দেশ শাসনে এসেছিল তখন থেকে পচনের শুরু। এরা পর্যায়ক্রমে দেশটিকে এমন এক জায়গায় এনেছিল যেখান থেকে বেরুতে আমরা এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এই সেদিন ও দেশের সংবিধান নামক পবিত্র বইটিকে এরা বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত করে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো আইন কানুন বানানো হতো। দেশের মূল পরিচয় বদলে দিতে চেয়েছিল এরা। সে জায়গাটা এখনও একেবারে মুছে যায়নি। তাই আমাদের দেশের রাজধানী শক্তির উৎস হবার পরিবর্তে হয়ে আছে হয়ে আছে সমস্যা ও সম্ভাবনার মাঝামাঝি এক শহর। এখানে স্বাধীনতার ঘোষণার মূল উদ্যান থাকার পরও আমরা তর্ক করি কে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক। তরুণ-তরুণীদের ভেতর ইতিহাস জানার প্রক্রিয়া চালু করার কাজটাও হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তির সে সময় নাই হাতে। তাদের একদল অতীত নিয়ে ব্যস্ত। অতীতমুখী হবার ভেতর কৃতজ্ঞতা থাকলেও শক্তি বা সামনে যাবার প্রেরণা থাকে কম। তাকে নিজের মতো করে চলতে দিলেই একমাত্র উত্তরণ সম্ভব। সেটা তাঁরা হতে দিতে চান না। সবসময় একটা না একটা ইস্যু তৈরি করাই যেন বুদ্ধিজীবীর কাজ। আরেক দল আছে দেশের চরিত্র হনন ও স্বাধীনতা খর্ব করার কাজে মত্ত। এরা দুশমন দেশের আশীর্বাদপুষ্ট। এক সময় অর্থের যোগানও দিত এরা। এখনও গোপনে দেয়। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির দাবার চালে নিজেরা কোণঠাসা থাকায় আগের মতো ভূমিকা নেই তাদের। সে কারণে আমাদের তারুণ্যকে খুনের মতো জঘন্য কাজে ঠেলে দেয়াই এদের কাজ এখন। যার সর্বশেষ পরিণতি গুলশানের ঘটনা। আমাদের মতো মায়ার দেশে মমতার সমাজে এতটা হিংস্রতা বেমানান। আগেই বলেছি এরা তৈরি হয় অন্ধকারের গহ্বরে। এদের পেছনে টাকা ঢালে বিদেশী চক্র। যারা আমাদের জাতীয় ঔজ্জ্বল্য আর ঐক্যের আলো সহ্য করতে পারে না।
বাংলাদেশের যাবতীয় অর্জনের স্মারকগুলোও এদের আক্রোশের শিকার। শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ সবকিছুই তাদের টার্গেট। শুধু সময়ের পথ চেয়ে আছে এরা। এখন তাই আমাদের জানতে হবে বুঝতে হবে কি চাই আমরা? কিভাবে আমরা আমাদের ভবিষ্যতকে করবো নিষ্কন্টক। জাতীয় অর্জনের কাছে যাবার বিকল্প নেই। সেই রেসকোর্স আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের শহীদ মিনার আমাদের স্মৃতিসৌধ হোক তারুণ্যের অহংকার। যেসব জাতি বড় হয়েছে যাদের জীবন উন্নত যারা অগ্রসর তাদের মতো করে জাতীয় স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখার সময় এখন। মেঘে মেঘে বেলা কম হয়নি। এখন যদি আমরা শুরু না করি তাহলে কোনদিনও আমরা নিজেদের মতো করে বাঁচার দেশে থাকতে পারব না।
বাংলাদেশ ও তার ঐতিহ্য যাদের অহংকার, যারা এদেশের মাটির সন্তান, যাদের কাছে দেশ মানে মা, তারা যদি এর দিকে মনোযোগী না হয় আমাদের তিমির রাত কখনো আলোর মুখ দেখবে না। এই অগ্নিঝরা মার্চে আমরা যেসব অন্ধকার আর চোরাবালিতে ডুবে আছি তার থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ফিরতে হবে। দল-মত রাজনীতির বাইরে যে তিনি তাই যেন হয় আগামীর পাথেয়।
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ
প্রকাশকালঃ ৪ মার্চ ২০১৮