বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও রংপুরের শহীদ শংকুঃ এস.এম. আব্রাহাম লিংকন

4847

Published on মার্চ 3, 2018
  • Details Image

মার্চ মাস বাঙালির জীবনে অনন্য ও উথালপাতাল করা মাস। এ মাসেই বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ছাত্রনেতা আ স ম রব বাঙালির স্বপ্ন সংগ্রামের পতাকা উত্তোলন করেন। পৃথক পতাকা পৃথক রাষ্ট্রের এক প্রকার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, যার মাধ্যমে ছাত্ররা কার্যত অফিসিয়ালি পাকিস্তানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। এ ঘটনা যে পাকিস্তানিদের আর বিচলিত করেছিল সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। সমগ্র দেশ অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায় জনতা যতই বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনুগত হচ্ছিল, ততই পাকিস্তানিরা রুষ্ট হচ্ছিল বাঙালির ওপর। সমগ্র জাতি একজনের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হচ্ছিল। এই উত্তাল আবহ উত্তরের রংপুরের গ্রামগঞ্জকেও রোমাঞ্চিত করেছিল। মার্চের প্রথম দিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হলে রংপুরেও ২ ও ৩ মার্চ স্বতঃস্ম্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। সে সময় বৃহত্তর রংপুরে হাতেগোনা কয়টি কলেজ। রংপুরে স্কুল-কলেজের ছাত্ররা জনতার মিছিলে শামিল থেকেছে সমানতালে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হলেও প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মিছিলের বাইরে ছিলেন না। পাকিস্তানের দালালরা ছাড়া কেউই মিছিল-মিটিংয়ের বাইরে থাকতেন না। যারা মিছিলে যেতেন তাদের সবার রাজনৈতিক দলগত সদস্যপদ না থাকলেও প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্বের জায়গাটি ছিল, তিনি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পাড়ের সবাইকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একরেখায় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধনী-গরিব, মুটে-মজুর সবার মুখে ধ্বনি দিতে পেরেছিলেন, 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা', 'তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি'। বামপন্থিদের ধনী-গরিবের প্রভেদের বিরুদ্ধে উত্থিত স্লোগানকে ছাপিয়ে বাঙালির মনে 

ঠাঁই নিয়েছিল এই স্লোগানগুলো। যেখানে ধনী-গরিব, মুটে-মজুরকে বিভেদরেখা ভুলে একরেখায় হাজির করা গিয়েছিল।

সংগ্রামের উত্তাল ঢেউগুলো সারাদেশের মতো রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর অঞ্চলকেও উদ্বেলিত করেছিল। জাতীয়ভাবে ঢাকায় ২ মার্চের পতাকা উত্তোলন উত্তর জনপদের ছাত্রদের উজ্জীবিত করেছিল। এর পরদিন ৩ মার্চ রংপুর হয়ে উঠেছিল এক অগ্নিগর্ভ শহর। রংপুর যেমন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে ছিল সরব, তেমনি ছিল পাকিস্তানি দালালদের শক্ত কেন্দ্র। জেলা শহরের আলমনগর রবার্টসনগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় বসবাসরত বিপুল সংখ্যক অবাঙালির পাকিস্তানপ্রীতিও ছিল উল্লেখযোগ্য। পাশেই সৈয়দপুর, বোনারপাড়া, লালমনিরহাটেও বিপুল পরিমাণ অবাঙালির বসবাস পাকিস্তানি দালালদের জন্য বড় পুঁজি ছিল। তাদের নেতা ছিল রংপুরের সরফরাজ খান, যিনি ধন-দৌলতেও বলবান ছিলেন। ছিলেন রংপুরে পাকিস্তানিদের নেতা। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে দমানোর সব পরিকল্পনায় তার ভূমিকার কথা তদানীন্তন বাঙালি নেতৃত্ব ভালো করে জানতেন। তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলিম লীগারদেরও আস্থার প্রতীক। 

২ মার্চ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুর রউফ রংপুরে ছিলেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে শহরের পাঙা হাউসে রাতভর বৈঠক করেন। পরদিন ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় রংপুরে ছাত্রলীগ নেতারা শহরের কাছারি বাজার এলাকা থেকে অল্প কয়েকজনকে নিয়ে হরতালের সমর্থনে মিছিল শুরু করেন। পথে মিছিলে হাজারো বাঙালি দলমত বয়স নির্বিশেষে মিছিলে যোগ দিতে থাকে। মিছিলটি জঙ্গি হলেও সুশৃঙ্খল ছিল। মিছিলে প্রেস ক্লাবের কাছে যোগ দেন এমপিএ সিদ্দিক হোসেন, এমএনএ সোলায়মান মণ্ডল। মিছিলের গন্তব্য ছিল তেঁতুলতলা পর্যন্ত। সেখান থেকে ফেরার কথা শহরে; কিন্তু তেঁতুলতলায় এসে যুক্ত হয় কারমাইকেল কলেজ থেকে আসা ছাত্রদের বিশাল মিছিল ও সংগঠিত শ্রমিকরা। স্থানীয় শ্রমিক ও ছাত্রলীগ নেতাদের চাপে মিছিলটি রংপুর রেলস্টেশনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিলে সেদিন রংপুর শহরের স্কুল-কলেজের সব ছাত্র স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। মিছিলটি যখন বর্তমান দুর্নীতি দমন অফিসের সামনে পৌঁছায়, তখন স্কুলছাত্র শংকু একটি উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখিয়ে বলে, 'ঐ তো উর্দু লেখা সাইনবোর্ড'- এ কথা শোনামাত্র শংকুর মতো অনেকেই উত্তেজিত হয় এবং সাইনবোর্ড গুঁড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে। ওই বাড়ির ভেতর থেকে মিছিল লক্ষ্য করে অবাঙালি নেতা সরফরাজ খান গুলি ছুড়লে সে গুলি গুপ্তপাড়ার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শংকু সমঝদার ও শরিফুল আলম মকবুল নামে দু'জন শিশুর মাথায় লাগে। শংকুকে হাসপাতাল নেওয়ার পথে সে মৃত্যুবরণ করে। শংকু সমঝদার শহীদ হওয়ার খবরে রংপুরের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। শহরের বাড়িঘর, অফিস-আদালত থেকে সব মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সব অবাঙালির বাড়িঘর, দোকানপাটে বাঙালিরা আক্রমণ করে। পরিস্থিতি সামলাতে ইপিআর বাহিনীকে রংপুর শহরে নামানো হয়েছিল, কারফিউ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছিল। তাতেও বাঙালির বিক্ষোভ দমানো সম্ভব হয়নি। বরং মিছিল-মিটিংগুলোতে মানুষের উপস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তটস্থ করে তোলে। সেদিন ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম গোলাপ, খোন্দকার মুখতার ইলাহী, অলক সরকার, নুরুল রসুল চৌধুরী, মুকুল মোস্তাফিজ, ইলিয়াস আহমেদ, জননেতা মোহাম্মদ আফজাল হোসেন, ইয়াকুব আলী জরজেস, সিদ্দিক হোসেন, শাহ আবদুর রাজ্জাক, আবদুল আউয়াল, আজিজুল ইসলাম সেলিম, শংকর বসু, শ্রমিক নেতা ফুলু সরকারসহ অনেকেই মিছিলে শামিল হন। শংকু সমঝদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিভেদরেখা ভুলে রংপুরের সব রাজনৈতিক দল একমঞ্চে এসে পড়ে। ওইদিন রংপুর কলেজের ছাত্র মিঠাপুকুরের আবুল কালাম আজাদ ও মুলাটোলের ওমর আলী নামে আরও দু'জন বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দেন। শংকুর সঙ্গে গুলিবিদ্ধ অপর শিশু মকবুল এক মাস পর মৃত্যুবরণ করেন। 

শংকু সমঝদারসহ ৩ মার্চে রংপুরের শহীদদের আত্মদান রংপুরকে মহীয়ান করেছে। পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলোর একটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ওই ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন- 'ভাইয়েরা আমার আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়- আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।' ৩ মার্চে শংকু সমঝদারের আত্মদানের কারণেই সেদিন ৭ মার্চের ভাষণে রংপুরের কথা উঠে এসেছিল। ৭ মার্চের বক্তব্য ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। সে ইতিহাসে রংপুরের নাম শংকুর কারণেই। আজ ৩ মার্চ শহীদ শংকু সমঝদারের জীবনদানের দিন। বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের উষালগ্নে রংপুর জেলা তথা উত্তর জনপদের প্রথম শহীদ শংকু সমঝদার। শুধু তাই নয়, দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বাধীনতার জন্য প্রথম শিশু শহীদও শংকু সমঝদার। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু শংকু সমঝদারের স্মৃতিরক্ষার জন্য কিছুই হয়নি। এমনকি তার নামটি শহীদের তালিকাভুক্ত নয়। জাতীয় বা স্থানীয়ভাবে তার নামে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাকে তেমনভাবে তার স্কুল বা রংপুরের শিক্ষা ও সংস্কৃতি অঙ্গনে স্মরণ করাও হয় না। যতটুকু হয় তা পারিবারিকভাবে। সেটিও নিয়মিত নয়। মায়ের তিরোধানের পর সেটিও আবশ্যিকভাবে শ্নথ হবে। 

আগামী প্রজন্মের জন্য স্বাধীনতার এই বীর শিশু শহীদের নামে কেন্দ্রীয় বা রংপুর শিশু একাডেমির মিলনায়তন কিংবা প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি করে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের নাম শহীদ শংকু সমঝদার ও শহীদ শরিফুল আলম মকবুলের নামে নামকরণ করতে পারে। 

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত