5961
Published on মার্চ 1, 2018‘ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে সেই কবে থেকে আমাদের প্রবল আবেগ নানা ফর্মে প্রকাশ পেয়ে এসেছে। ভাষা আন্দোলন বায়ান্ন তথা ‘একুশে’ তার উৎস, তার রূপকার। সময় তাকে পরাজিত করতে পারেনি। তবু মানতে হয়, এ আবেগের শেষ গতি যতটা নবনির্মাণে, তার চেয়ে বেশি একালের গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতায়। যেমন—মহান একুশের অনুষ্ঠানমালায়। তাতে একুশের স্বপ্নপূরণ হোক বা না হোক।
প্রায় অনুরূপ ঘটনা কৃষ্ণচূড়ার রক্তরঙা হলুদের মিশ্ররূপে রাজপথে ছায়া আঁকা ‘মার্চ’ বিশেষ কারণে হয়ে উঠেছে ‘স্বাধীনতার মাস’। এর সূচনাতেই পরোক্ষে স্বাধীনতার দামামা বাজানো বিশেষ তাৎপর্যে চিহ্নিত হয়ে উঠে একদিকে নিয়মতান্ত্রিক, অন্যদিকে সংগ্রামী চেতনার মিশ্র ধারায়। যদি প্রতীকের কথা তুলি, তাহলে বলতে হয়, এর প্রকাশ প্রধানত জাতীয়তাবাদী চেতনায়, অংশত জনমুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
এখানেও আবেগ একুশের চেয়েও অধিকতর তীব্রতায় ও দাবদাহে প্রকাশ পায়, যেমন—অসহযোগের ঐতিহ্যবাহী নিয়মতান্ত্রিকতায়, তেমনি ছাত্র-জনতার ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধরূপের রাজপথ পরিক্রমায়, স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে এক লক্ষ্যে পৌঁছানোর অগ্নিগর্ভ তাড়নায়। একুশের মতোই ঢাকা হয়ে ওঠে মিছিলের নগরী।
এ অবস্থায় প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল ষাটের দশকের প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার অগ্নিগর্ভ রূপ, মূলত ঢাকার রাজপথে। বহুকথিত উনসত্তরের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থান পরিস্থিতির একটি চমকপ্রদ উদাহরণ। বাস্তবে আইয়ুবি শাসন এমনই এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, যার ধারাবাহিকতায় তার পতন এবং সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতায় আসীন হওয়া।
তবে মূল বিষয়টি ছিল ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং তাতে জাতীয়তাবাদী চেতনার ধস নামানো অভাবিত বিজয়। আওয়ামী লীগের সে বিজয় শাসকশ্রেণির প্রত্যাশিত ছিল না, তাদের হিসাব-নিকাশে ধরা ছিল না। তবে ষাটের দশকের শেষার্ধের অভিজ্ঞতায় এমনই সাধারণ মানুষের চেতনা ধরা ছিল। ছিল রাজনৈতিক নেতা ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের বিচার-বিবেচনায়।
এ অভাবিত ঘটনা মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি, বিশেষ করে সামরিক শাসকবর্গ, যারা চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান তখন বিস্ফোরক অবস্থানে, মূলত ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। বিস্ময়কর ঘটনা হলো এ ক্ষেত্রে ছাত্রযুবা, রাজনীতিক, বিভিন্ন শাখার পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী সবাই জাতীয়তাবাদী মঞ্চে এক কাতারে দাঁড়ানো।
কারণ আর কিছু নয়। চেতনাগত মূল বিষয়, বাঙালি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি আর সব দাবি ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠে দুই পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে। ছয় দফা, ১১ দফা, ১৪ দফা একাকার হয়ে যায়। এর প্রবলতায় শ্রেণিচেতনা, শ্রেণিসংগ্রামের ডাক পিছিয়ে পড়ে।
পূর্ববঙ্গীয় রাজনীতির এ অভাবিত বাঁক ফেরার বিষয়টি হয়তো প্রবীণ জননেতা মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন, অথবা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর রাজনৈতিক দল ন্যাপ সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসেনি। বরং মাঝেমধ্যে মূল লাহোর প্রস্তাবের পক্ষে বা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবিতে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন ভাসানী। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন এমনই ছিল।
ওই যে বহুকথিত প্রবাদবাক্য : ‘সব পথ রোমের দিকে’ বা গোয়েন্দা সাহিত্যের দিকপাল আগাথা ক্রিস্টির পূর্বোক্ত ধারায় লেখা চমকপ্রদ উপন্যাস, ‘ওরা সবাই বাগদাদে’, পূর্ববঙ্গে তখন এমনই এক অবস্থা রাজনীতির সব পথ জাতীয়তাবাদী চেতনার শিবিরমুখী। সামরিক শক্তির গর্বে অন্ধ পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি বিরাজমান পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিল বলে আমার মনে হয় না।
তাই পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী ছয় দফা তথা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কারণটা যেমন শ্রেণিস্বার্থের, তেমনি বিশেষভাবে পশ্চিম পাকিস্তান তথা পাঞ্জাবিপ্রধান সামরিক স্বার্থের। এখানে কোনো প্রকার আপসরফার সুযোগ নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ছয় দফার বাস্তবায়নে অনড়। কারণ সেটা তাদের নির্বাচনী ম্যান্ডেট।
দুই.
পয়লা মার্চ, ১৯৭১। আগেই বলেছি, ঢাকার রাজপথের দুই পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার ডালে লাল-হলুদের সমারোহ। রাজপথে তার রংমাখা ছায়ার সুদর্শন আঁকিবুঁকি, যতটা প্রকৃত সৌন্দর্যের, তার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রক্তাক্ত সংগ্রামের প্রতীকে। নানা টানাপড়েনের মধ্যে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্টের শেষমেশ ঘোষণা, ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ঢাকায় তেসরা মার্চ (১৯৭১)।
এবার বাঙালি জনমানসে কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু সন্দেহবাদীদের মনে অস্বস্তি থেকেই যায়, এ ঘোষণা কি আদৌ বাস্তবায়িত হবে? কারণ নির্বাচনের পর অনেক টালবাহানা শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই ঘোষণা স্বভাবতই অনেকের মনে সন্দেহের অবকাশ তৈরি করে। সন্দেহ-সংশয় যে ভিত্তিহীন ছিল না, তার প্রমাণ মেলে অতি দ্রুতই, পয়লা মার্চে।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণা : ‘অনিবার্য কারণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত।’ স্থগিতাদেশের মূল কারণ ছয় দফা নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাগড়া। তার পেছনে উগ্রপন্থী জনাকয় জেনারেলের সমর্থন অথবা তাদেরই উসকানি। এর মর্মার্থ হলো, বাঙালিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে এমন সুবিধা, যা সামরিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
এর অর্থ, ছয় দফার সব দফা ভুট্টো ও নেপথ্য নায়কদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। ওখানে সংশোধন আনতে হবে। কিন্তু নির্বাচনী ম্যান্ডেট হিসেবে ছয় দফা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ অনড়। তারা জনমতের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পয়লা মার্চের ঘোষণা যেন রাজনীতির মৌচাকে ঢিল। বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেমন রাজনৈতিক মহলে, তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র-জনতার মধ্যে।
সে প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেল উত্তাপ-উত্তেজনা ও বিস্ফোরণের প্রকাশ। কেউ তাদের ডাকেনি। কেউ তাদের নির্দেশ দেয়নি। আপন তাগিদে তারা ঘোষণা শোনা মাত্রই অফিস, আদালত বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে আসে ঢাকার রাজপথে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার পথে পথে ক্ষুব্ধ মানুষের উপস্থিতি। রাজপথ জনারণ্যে পরিণত।
এ দৃশ্য যত অভাবিত মনে হোক, না দেখলে এর বাস্তবতা বোঝা যাবে না। উত্তেজিত জনারণ্যের চরিত্র বিচিত্র ধরনের। সেখানে উপস্থিত ছাত্রযুবা, সরকারি-বেসরকারি অফিসের নানা বয়সী কর্মচারী-কর্মকর্তা। দৃশ্যচিত্রটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার। অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা শোনার পরপরই স্বতঃস্ফূর্ত তাড়নায় কর্মস্থল থেকে ছুটে বেরিয়ে যায় প্রথমে তরুণ অফিসকর্মীরা, এরপর ধীরে-সুস্থে বয়স্কদের অনেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসগুলো প্রায় জনহীন। কেউ কারো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।
সেদিন মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত হোটেলশিল্পে কথিত বাঙালিয়ানার প্রতীক ‘পূর্বাণী’ হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির বৈঠক চলছে। সেখানেও ওই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট উত্তেজনা-উত্তাপ। বৈঠকে উপস্থিত সর্বজনবন্দিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাই সবার লক্ষ সেদিকে। মানুষ জননেতার প্রতিক্রিয়া জানতে চায়, করণীয় সম্পর্কে শুনতে চায়।
এ অবস্থায় কী বলবেন, কী বলতে পারেন নেতা? তাঁর মনেও প্রবল উত্তেজনা, টেনশন। হয়তো ভাবছেন, কী হতে পারে এ ঘোষণার পরিণাম? তা যা-ই হোক, প্রতিবাদ তো করতেই হবে। জনগণ তাঁর পেছনে মুঠো হাত তুলে দাঁড়ানো। এদের আকাঙ্ক্ষার মূল্য দিতে হবে। তবে তা ভেবেচিন্তে, ধীরস্থির বিচারে। সহিংসতার বাঁধ ভাঙতে দেওয়া যাবে না।
হয়তো এমন ভাবনার মধ্যে ভেতরে সাংবাদিক, বাইরে উত্তেজিত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে জননেতার সুচিন্তিত বক্তব্যের মর্মকথা হলো; সাত কোটি বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি যেকোনো প্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবচেয়ে জরুরি জনগণের ঐক্য, ঐক্যবদ্ধ নিয়মতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম। ৭ই মার্চের জনসভায় পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আপাতত ঢাকায় এক দিনের হরতাল, তেসরা মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল। এ ধারায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
মার্চের রৌদ্রদগ্ধ উত্তপ্ত ঢাকার আবহাওয়া। জনমনের উত্তাপ বুঝি তাতে যুক্ত হচ্ছে। নেতার মুখ স্বেদাক্ত। সম্ভবত উত্তাপে উত্তেজনায়। কণ্ঠস্বর ভরাট কিন্তু আর্দ্র, তপ্ত। তুখোড় দু-একজন সাংবাদিকের প্রশ্নও পরিস্থিতি বিচারে এককভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হবে কি না। নেতার জবাব : ‘অপেক্ষা করুন’।
কিন্তু ছাত্র-জনতা এতটাই উত্তেজিত, ক্ষুব্ধ, উত্তপ্ত যে তারা অপেক্ষা না করেই এক পা এগিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ঘরানার ছাত্রসমাজের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সভায় তার চরম প্রকাশ। কারণ এ দেশের ছাত্র-যুবসমাজ তো রাজনৈতিক পদক্ষেপে বরাবর এক পা এগিয়ে থেকেছে। রাজনীতিকে কখনো কখনো দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
সেদিনের রৌদ্রতপ্ত, উত্তেজিত ঢাকা ছিল চরমপন্থার অনুসারী। এক তরুণ শ্রমিক নেতার ভাষায়: ‘মাউড়াদের সঙ্গে আর একত্র থাকা চলবে না।’ ছাত্রদের বড়সড় অংশের ভাবনা : ‘এ দেশে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে হবে।’ তবু আদর্শগত বিচারে কিছুটা ভিন্নতা তো ছিলই, যেমন ছাত্র-যুবাদের তেমনি রাজনৈতিক মহলের ছোটখাটো একাংশে।
তবে সেদিনকার (১ মার্চ) একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসে ততটা গুরুত্বে উল্লিখিত নয়। আর তা হলো, সংবাদ সম্মেলন শেষে এক ফাঁকে ক্ষুব্ধ নেতার বঙ্গভবনে গিয়ে গভর্নর আহসানকে অনুরোধ, যাতে সংসদ অধিবেশনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়। তাতে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হবে।
কিন্তু স্বার্থবাদী সামরিক শাসক সেসব পরামর্শে কান দেয়নি। বরং এমন এক যুক্তিসংগত, সাধুপ্রচেষ্টার দায়ে গভর্নর আহসান ও সামরিক আইন প্রশাসক সাহাবজাদা ইয়াকুবকে তাঁদের পদ ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে হয়। সেসব অবশ্য পরের কথা।
কিন্তু বড় কথা হলো, পয়লা মার্চের অগ্নিগর্ভ দিনটির সূচনা ঘটান যেমন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, ভুট্টোসহ চরমপন্থীদের পরামর্শে, তেমনি এ দিনটির ধারাবাহিকতায় পঁচিশে মার্চের গণহত্যার সূচনা এবং পাকিস্তান ভাঙার পরিণাম তৈরি হয় একই দুষ্টচক্রের অর্বাচীন সিদ্ধান্তে ও পদক্ষেপে। সংক্ষিপ্ত ৯ মাসের যুদ্ধে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। পয়লা মার্চের ঘটনার জের ধরে মার্চ হয়ে ওঠে কৃষ্ণচূড়ারঙে রঞ্জিত স্বাধীনতার মাস।
লেখক : আহমদ রফিক
কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী
সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ