204
Published on জুলাই 6, 2024১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রাম পরিদর্শন করেন এবং নদী ভাঙন কবলিত ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় পরিবারগুলোকে গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশ লাখ লাখ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সে সব গৃহহীনের অনেককেই কাদামাটি ও কাঁচা ইট দিয়ে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ীতে এখনো সেরকম দুয়েকটি ঘর রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ক্ষতিগ্রস্তদের গৃহনির্মাণ শেষ করার আগেই তাঁকে সপরিবারের হত্যা করা হয়। গৃহহীনদের বেদনা বঙ্গবন্ধু যেমন বুঝেছিলেন, তেমনি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছাদহীন জীবনের কষ্টগুলোকে উপলব্ধি করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গৃহহীন ও ভূমিহীনদের ঘরবাড়ি ও জমির মালিকানা দিতে ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্প হাতে নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা হলো উপার্জন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা,সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, জমিসহ ঘরের মালিকানায় নারীর ক্ষমতায়ন, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ অর্জন, দক্ষতা উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, গ্রামেই শহরের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে, তৃতীয় লিঙ্গ, জলবায়ু উদ্বাস্তু, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীসহ সকল ভূমিহীন-গৃহহীন জনগোষ্ঠীকে জমিসহ ঘর দিয়ে তাদের সামাজিক মানমর্যাদা উন্নত করা এবং তাদেরকে উন্নয়নের মূলস্রোতে নিয়ে আসছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ বলে ঘোষণা দেন।
উপকারভোগীর সংখ্যা ও পুনর্বাসন পদ্ধতি বিবেচনায় এটি বিশ্বের বৃহত্তম সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচি। কিছুদিন আগেও যাদের ছিল না কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই, তারা এখন রঙিন টিন আর আধাপাকা বাড়িতে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রীর মানবিক কর্মসূচির বদৌলতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পেয়ে বদলে গেছে দেশের লাখ লাখ পরিবারের জীবনচিত্র। দুই শতক জমিসহ ঘর পাওয়ার পর প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে কৃষি থেকে শুরু করে নানান কাজের মধ্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন তারা। গৃহহীন এসব হতদরিদ্র মানুষেরা বাড়ির আশ্রয়ণের আঙ্গিনায় শাক-সবজির চাষ করছেন, আবার কেউ কেউ হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, কবুতর লালন পালন করে স্বনির্ভর হয়েছেন।
এখন পর্যন্ত ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৭টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হয়েছে। উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা ৪৩ লাখ ৩৯ হাজারেরও বেশি।
আশ্রয়ণ মানে কেবল আবাসনের ব্যবস্থা নয়; বরং এটির পরিধি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। উপকারভোগীরা দুই শতাংশ করে জমি পেয়েছেন; একটি অর্ধপাকা দুই কক্ষের ঘর পাচ্ছেন; বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ লাগছে এখানে এবং এতে রয়েছে গোসলখানা, টয়লেট ও রান্নাঘর।
গৃহসহ জমি স্বামী-স্ত্রী উভয়ের নামে যৌথভাবে দলিল করে দেয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানো হচ্ছে। প্রতি ১০টি পরিবারের সুপেয় পানির জন্য থাকছে একটি করে নলকূপ। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকবেন সুবিধাভোগীরা। তাদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্মিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। আশ্রয়ণের ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের শরীর গঠন ও বিনোদনের জন্য প্রকল্প এলাকায় রয়েছে খেলার মাঠ। একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক গ্রামের সব নাগরিক সুবিধাই থাকছে আশ্রয়ণ প্রকল্পে।
উপকারভোগীদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পেশামুখী ১০ দিনের প্রশিক্ষণ। বিশেষ করে ব্যারাকে বসবাসকারী সুবিধাভোগীদের মৎস্য চাষ, পাটি বুনন, নার্সারি, নকশীকাঁথা, ওয়েল্ডিং, ইলেকট্রিক ওয়ারিং এবং রিকশা-সাইকেল-ভ্যান গাড়ি মেরামতের মতো ৩২টি পেশায় প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
এই প্রশিক্ষণ চলাকালে তাদের আয়-রোজগারের যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য প্রতিদিন ৭৫০ টাকা করে ভাতা দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ পরবর্তী সময়ে উপকারভোগীরা সমবায় সমিতি গঠন করে আয়-বর্ধনকারী ব্যবসা বা পেশা চালুর জন্য ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ পাচ্ছেন। ব্যারাকে পুনর্বাসিত পরিবার প্রতি প্রাথমিকভাবে তিন মাসের ভিজিএফ-এর আওতায় খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
মাতৃত্বকালীন, বয়স্ক, বিধবা, বা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন তারা। অর্থাৎ একজন নিঃস্ব ব্যক্তিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় মানবসম্পদে পরিণত করে আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সব নাগরিকের জন্য মৌলিক উপকরণ প্রাপ্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০২৩ সালের নির্বাচনি ইশতেহারের ৩.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
পরিবেশ ও জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য মাননীয় প্রধামন্ত্রীর অঙ্গীকার পূর্ণতা পেয়েছে। আশ্রয়ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) এর ১নং দারিদ্র্যের অবসান, ২নং ক্ষুধা নির্মূল, ৩নং স্বাস্থ্যসেবা, ৪নং মানসম্মত শিক্ষা, ৫নং লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, ৬নং সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন, ৮নং উপযুক্ত কর্মসংস্থান, ১০নং অসমতা কমিয়ে আনা এবং ১১নং টেকসই ও নিরাপদ জনবসতির মতো অনেকগুলো লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য আসছে।
ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারণার প্রচলন ছিল। বৈদেশিক সাহায্য, খাদ্য সহায়তা, ত্রাণ প্রদান এবং ক্ষুদ্র ঋণের নামে শোষণ ও বঞ্চনার কারণে একজন দরিদ্র ব্যক্তি চরম দারিদ্র্যদশার মধ্যে পতিত হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক ড্যানি রড্রিক পূর্ব এশিয়ার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমির মালিকানা পুনর্বণ্টন গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কাজ করে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে উপকারভোগীরা ঘরসহ ভূমির মালিকানা পাওয়ার পাশাপাশি আয়বর্ধক কাজে সম্পৃক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাদের মেধা ও শ্রম দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও পরিবার হীনমন্যতা কাটিয়ে একটি সম্মানজনক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখছে। এভাবেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সামিল করছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
নরওয়েজিয়ান একাডেমিক-বিশ্লেষক ড. অ্যাটল পিয়ারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পকে বিশ্বের মধ্যে অনন্য ও মৌলিক একটি প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। পিয়ারসন বলেছেন, সরকারি জমিতে স্থায়ী বাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করে ভূমিহীনদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করার নজির বিশ্বে বিরল এমন লোকদের মালিকানা দেওয়ার নজির নেই। আশ্রয়ণ শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বে একটি অনন্য প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্যার্থে নানা উদ্যোগ থাকলেও সরকারি জমিতে স্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করে ঠিকানাহীন মানুষকে মালিকানা দেওয়ার নজির যেমন নেই অনুরূপ সরকারি খরচে বিদ্যুৎ ও স্যানিটেশন সুবিধাসহ বাড়ি নির্মাণের বিষয়টিও একটি অভিভূত হওয়ার মত ঘটনা।