194
Published on জুন 25, 2024প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশ ও জনগণের জন্য যে প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি লাভজনক তা গ্রহণ করবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা তিস্তা প্রকল্প নিয়েছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীন ও ভারত আলাদা আলাদা প্রস্তাব দিয়েছে। আমাদের দেশের জনগণের জন্য কোন প্রস্তাবটি অধিক লাভজনক ও উপযোগী হবে সেটাই আমরা গ্রহণ করবো।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে চীন আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতও দিয়েছে। আরও প্রস্তাব এসেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবশ্যই আমরা বিবেচনা করবো, কোন প্রস্তাবটি গ্রহণ করলে তা আমার দেশের মানুষের কল্যাণে আসবে সেটাই আমি গ্রহণ করবো। কোন প্রস্তাবটা নিলে কতটুকু ঋণ নিলাম এবং কতটুকু আমাদের পরিশোধ করতে হবে, কতটুকু দিতে পারবো-এসব কিছু বিবেচনা করেইতো আমাদের করতে পরিকল্পনা নিতে হবে।’
সরকার প্রধান বলেন, সে ক্ষেত্রে ভারত যেহেতু বলেছে তারা করতে চায় এবং টেকনিক্যাল গ্রুপ বানাবে, তারা অবশ্যই আসবে। আমরা যৌথভাবে সেটা দেখবো। চীন একটা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। ভারতও একটা করবে এবং এটার পর আমাদের কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রহণযোগ্য ও লাভজনক মনে হবে আমরা সেটাই করবো।
শেখ হাসিনা বলেন, যেহেতু ভারতের কাছে আমাদের তিস্তার পানির দাবিটা অনেক দিনের সেক্ষেত্রে ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রকল্পটি করে দেয় তবে আমাদের সব সমস্যারই সামাধান হয়ে যায়। তাহলে সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ হলো-আপনারা নিজেরাই বিবেচনা করে দেখেন।
তিনি বলেন, কাজেই ভারত যখন এগিয়ে এসেছে আমরা এটাই মনে করি যে ভারতের সাথে যদি আমরা এই তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করি তাহলে আমার দেশের পানি নিয়ে প্রতিদিন সমস্যায় পড়তে হবে না। আমরা সেই সুবিধাটা পাব।
প্রধানমন্ত্রী দেশের জাতির পিতার দিয়ে যাওয়া পররাষ্ট্র নীতি ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়,’ এর প্রসঙ্গ টেনে অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমিতো এখানে কোন সমস্যা দেখি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি যখন আমাকে তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে যাবার দাওয়াত দিলেন, আমরা গেলাম। তারপর তিনি রাষ্ট্রীয় সফরের দাওয়াত দিলেন, সে সফরও করে আসলাম। চীন আমাকে দাওয়াত দিয়েছে আমি চীনে যাব। আমার বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ এবং সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়েই আমি চলবো। কার কি সমস্যা সেটা তাদের সঙ্গে থাক আমার নয়, আমার দেশের মানুষের কতটুকু উন্নতি করতে পারি সেটাই আমার লক্ষ্য।
ভারত বাংলাদেশের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তারাও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল।
শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ২১ ও ২২ জুন নয়াদিল্লি সফর করেন।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর ভারতে কোনো সরকার প্রধানের এটিই প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর। এছাড়াও, এই সফরটি ছিল ১৫ দিনেরও কম সময়ের মধ্যে ভারতের রাজধানীতে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সফর। কারণ, তিনি ৯ জুন মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট জনদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও জাতীয় সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ও উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলন সঞ্চালনা করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন,“সমস্যা থাকলে সমাধানও আছে।”
গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালের শেষ হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যদি চুক্তিটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন নাও করা হয় তাহলেও তা অব্যাহত থাকবে।
তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে ভারত সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তি উত্থাপন সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। কেননা এটা তাদের (ভারত) অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু ভারতের সকল রাজনৈতিক দল এবং প্রধানমন্ত্রী নেরেন্দ্রে মোদী এবং মূখ্য মন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমার সঙ্গে সবার সম্পর্ক ভালো। মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো, আবার প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও। অন্যান্য সব দলের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালো। ভারতের দল মত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক আছে।”
বাংলাদেশের ভেতরে দিয়ে ভারতের রেল চলাচলের সুযোগ দেওয়ার নামে দেশকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটা দেশের মধ্যে অন্য দেশের ট্রানজিট দিলে ক্ষতি কি?
তিনি বলেন, রেল যেগুলো বন্ধ ছিল (ভারতের সঙ্গে) সেগুলো আস্তে আস্তে খুলে দিচ্ছি। অর্থনীতিতে এটা বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশে কী চারদিকে দরজা বন্ধ করে থাকব? ইউরোপের দিকে তাকান সেখানে কোনো বর্ডার নেই। সেখানে কী এক দেশ আরেক দেশের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে?
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। মুক্তিযুদ্ধ করে এ দেশ আমরা স্বাধীন করেছি। যারা সমালোচনা করে তাদের জানা উচিত, একটি মাত্র মিত্র শক্তি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে ট্রেনিং পেয়েছে। পৃথিবীতে যারা মিত্র শক্তি, যারা যুদ্ধে সহযোগিতা করে, তারা কিন্তু ওই দেশ ছেড়ে কোনদিন ফেরত যায়নি। এখনো জাপানে আমেরিকান সৈন্য, জার্মানিতে রাশিয়ান সৈন্য রয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ দেখলে সে দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। সেখানে ভারত কিন্তু ব্যতিক্রম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত মিত্র শক্তি হিসেবে আমাদের পাশে থেকে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু, যখনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছেন তারা (ভারতের সৈন্য) দেশে ফেরত যাক, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়েছেন এবং তাদের ফেরত নিয়ে গেছেন। এরপরও যারা বলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে? সে বিক্রিটা হয় কিভাবে? সেটাই আমার প্রশ্ন। আসলে যারা এটা বলে তারা নিজেরাই ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে আছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেখেছি, যখনই মিলিটারি ডিক্টেটররা (সামরিক স্বৈরাচার) ক্ষমতায় এসেছে- জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, তারা ওপর দিয়ে ভারত বিরোধী কথা বলেছে, আর ভারতে গিয়ে সেখানে পা ধরে বসে থেকেছে। এগুলো আমার নিজের দেখা, জানা। কাজেই এ ধরনের কথা বলার কোন অর্থ হয় না।
‘ছোট ভূখন্ডের হলেও আমরা স্বাধীন ও স্বার্বভৌম দেশ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং স্বকীয়তা বজায় রেখে এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই আমরা কাজ করছি। আজকে আমরা এই যে সব যোাগাযোগ ব্যবস্থা সব খুলে দিলাম তাতে সবথেকে বেশি লাভবান হবে আমাদের দেশের মানুষ। তাদের যোগাযোগ করতে হয়, যেতে হয়। চিকিৎসার জন্য যায়, পড়াশোনার জন্য যায়, অন্যান্য কাজে যায়, হাট-বাজার করতে যায়, আজমীর শরিফসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা যাতায়াত করে। সেক্ষেত্রে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রটাওতো আরো উন্মুক্ত হবে।
তিনি বলেন, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা এ দেশ বিক্রি করে না। কারণ, আমরা এদেশ স্বাধীন করেছি এটা তাদের মনে রাখা উচিত। আর যে কষ্টটা আমরা ভোগ করেছি সেটা আমরা জানি। যারা বিক্রির কথা বলছে তারা ’৭১ পাকিস্তানের দালালি করেছে বলেও তিনি সন্দেহ ব্যক্ত করেন।
এ সময় ভারতের ভেতর দিয়ে এনার্জি ট্রানজিট তৈরী করে নেপাল ও ভূটান থেকে জলবিদ্যুৎ নিয়ে আসার সরকারের উদ্যোগের জন্য সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর এ দুটি দ্রুত ও সংক্ষিপ্ত ভারত সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে।
তিনি বলেন, “এই সফর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরো বলেন, তাঁর সরকার আরও ৭টি বর্ডার হাট করবে এবং কানেকটিভির উন্নয়নে বিবিআইএন করেছে এবং এখন যেতে খুব একটা সমস্যা হয় না, অনেকেই কিন্তু যাতায়াত করছে।
চন্দ্রবোড়া (রাসেল ভাইপার)সাপের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়া সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
যুক্তরাজ্য সুপ্রিম কোর্টের যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দিনের বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রে প্রদত্ত রায়ের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে এবং যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার আমরা তা নিচ্ছি। ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের মামলাসহ সমসাময়িক নানা প্রশ্নেরও উত্তর দেন তিনি।