459
Published on মার্চ 28, 2024১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৬ মার্চকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া কোনো মানুষের পক্ষে পরাধীনতা কী তা কখনোই এবং কোনোভাবেই বোঝা সম্ভব নয়, এমনকি স্বাধীনতা কী তাও বোঝা সম্ভব নয়। কারণ, তারা পরাধীনতার কষ্ট কখনো বুঝতে পারেনি। যারা স্বাধীনতার জন্য স্বজন হারিয়েছেন, তারা কিছুটা হয়তো অনুধাবন করতে পারেন দিনটিকে।
তাও কী বুঝতে পারেন? যতটুকু পারেন সেটা স্বজন হারানোর কষ্ট। কিন্তু পরাধীনতা কী তাদের পক্ষে আদতে বোঝা সম্ভব? বর্তমান যারা নতুন প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, তারা হয়তো এই দিনটির মাহাত্ম্য ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারবেন না। কিন্তু পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে গেলেই এই দিনটির তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। কবি মহাদেব সাহা বাংলাদেশ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এ দেশের একজন হতে পেরে বলেছিলেন, ‘তোমার বুকের মধ্যে আমাকে লুকিয়ে রাখো, আমি এই মাটি ছেড়ে, মাটির সান্নিধ্য ছেড়ে, আকাশের আত্মীয়তা ছেড়ে, চাই না কোথাও যেতে, কোথাও যেতে’।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমি আমার নিজের দেশ নিয়ে অসম্ভব রকম আশাবাদী। আমাকে যদি একশোবার জন্মাবার সুযোগ দেওয়া হয় আমি একশোবার এই দেশেই জন্মাতে চাইব। এই দেশের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব। এই দেশের বাঁশবাগানে জোছনা দেখতে চাইব।’
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।’
পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনের ইতিহাসে মাত্র ২ বছর একটি বিকলাঙ্গ সংবিধান দ্বারা দেশ পরিচালিত হয়েছে। বাকি ২২ বছর সেই সংবিধানও ছিল না। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আমরা দেখিয়েছি, একটি দেশের জন্য ১ বছরেরও কম সময়ে একটি কার্যকর ও জনমতের প্রতিফলন ঘটে এমন একটি সংবিধান দেওয়া যায়। ১৯৬২ সলের শিক্ষা আন্দোলনের পর যখন ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন, তখন বাঙালি জাতি পেয়ে যায় তাদের মুক্তির সনদ।
মূলত ৬ দফার ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের বাংলাদেশ। ৬ দফা ঘোষণার কয়েক মাস পরই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবন্দি করা হয়। শুরু হয় বাঙালি জাতির এক নতুন সংগ্রাম। শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় নেতাদের জেলখানা থেকে মুক্ত করা এবং একই সঙ্গে আইয়ুব খানের শাসনের অবসান ঘটানো। বাঙালি জাতি ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হয়।
তারা শেখ মুজিবুর রহমানসহ রাজবন্দিদের মুক্ত করে এবং একইসঙ্গে আইয়ুব খানের এক দশকের শাসনের অবসান ঘটায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ১ বছরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন দেবেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ইয়াহিয়া খান নির্বাচন দেয়।
আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান/পূর্ব বাংলা) ও জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের দ্বিতীয় জনপ্রিয় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য গোঁ ধরে বসেন। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত অধিবেশন অনির্দিষ্টকলের জন্য স্থগিত করেন।
শুরু হয় বাঙালির অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই রাস্তায় বের হয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানে ২ তারিখ থেকে হরতাল পালিত হয়। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য পরবর্তীতে কী করণীয় তা বলে দেন। শুরু হয় জুলফিকার-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে তারা সময়ক্ষেপণ শুরু করে। মূলত সময়ক্ষেপণের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালিকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তারা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকা- শুরু করে। নাম দেয় অপারেশন সার্চলাইট। এটি মূলত ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা। যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১-এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০-এর নভেম্বরে সংঘটিত অপারেশন ব্লিটজ্-এর পরবর্তী অনুষঙ্গ।
অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চের মধ্যে সব বড় বড় শহর দখল করে এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে (২৬ মার্চ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হওয়ার একটু আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন, যা চট্টগ্রামে অবস্থিত তৎকালীন ই.পি.আর এর ট্রান্সমিটারে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়।
বাংলাদেশের আজ ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে যে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার মিশন শুরু হয়, তা প্রায় দেড় দশক ধরে চলে। বিশেষ করে জেনারেল জিয়ার দুঃশাসন। তবে বাংলাদেশের যে কারণে স্বাধীনতা প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজন এখন পূরণ হচ্ছে। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা সুদৃঢ় হচ্ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম সেই ধারা অব্যাহত রাখবে বলেই প্রত্যাশা করি। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীনতা তখনি আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।’ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশিত স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রত্যাশায় আমরা সবাই।
লেখক : ড. সাজ্জাদ হোসেন; অধ্যাপক ও সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ