655
Published on ডিসেম্বর 12, 2023জাহাঙ্গীর আলম সরকার:
নীলফামারী জেলার সদর থানায় খরখরিয়া নদীর অবস্থান। বাংলাদেশের উত্তর গ্রীষ্ম মণ্ডলে অর্থাৎ প্রায় কর্কটক্রান্তি রেখা বরাবর অবস্থিত নীলফামারী জেলা। ১৯৭১ সালে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাথে এই খরখরিয়ার তীরেই ঘটেছিলো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ইছামতী যুদ্ধের দায়িত্ব ছিলো মিত্রবাহিনীর ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধীনে থাকা ২১ রাজপুত রাইফেলসের ওপর। ইছামতির যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনন্য সাধারণ একটি ঘটনা। নীলফামারীতে ছোট-বড় বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনে, খরখরিয়ার যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নদী সমৃদ্ধ নীলফামারী যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের যুদ্ধের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। নদীতে অনভ্যস্ত পাকিস্তান সামরিক বাহিনী প্রতিবার হোচট খেতে থাকে। খরখরিয়ার যুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ভয়ঙ্কর বর্বরতার শিকার হয়।
খরখড়িয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানের ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সর্বশেষ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। এই রেজিমেন্ট মূলত পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে ঠাকুরগাঁও দখল করেছিল; কিন্তু মিত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধে টিকে থাকতে না পেরে পিছু হটে প্রথমে নীলফামারী-দিনাজপুর সীমান্তে ইছামতী নদীর ধারে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পরে ইছামতীর প্রায় এক হাজার গজ অদূরে খরখড়িয়া নদীর ধারে আরেকবার শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে, যাতে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট মিত্র বাহিনীর দখল না হয়ে যায়। এ সংবাদ পাওয়ামাত্রই ইছামতী থেকে রাজপুত ব্যাটালিয়নের সেনা সদস্যরা কাথপালিয়ার নেতৃত্বে দ্রুতই খরখড়িয়ার দিকে এগোতে থাকে। ফলে ওই দিনের শেষভাগে খরখড়িয়ার প্রান্তরে রাজপুত ব্যাটালিয়নকে আরেকটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হলো। এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনী সম্পূর্ণভাবে ৪৮ পাঞ্জাবকে পরাজিত করে গ্রেফতার করতে পারে। যদিও মিত্র বাহিনীকে দুটি ট্যাংক হারাতে হয়েছিল; কিন্তু চূড়ান্তভাবে বিকেল ৫টার মধ্যে।
খরখড়িয়ার যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। সৈয়দপুর-পঞ্চগড় অক্ষ বরাবর খরখড়িয়ার যুদ্ধই ছিল সর্বশেষ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান। সে কারণে ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে খরখড়িয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। পাকিস্তানিদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে একটা ছোট্ট চাল মিত্র বাহিনীকে দারুণভাবে সাহায্য করেছিল। যখন ‘এ’ কোম্পানির একটিমাত্র ট্রুপ মূল শিবির থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মকভাবে সড়কের দুই পাশ বরাবর এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ সবগুলো কোম্পানিই পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ‘এ’ কোম্পানির এই প্লাটুনটাই পাকিস্তানি বাহিনীকে ওদের দিকে স্বয়ংক্রিয় ভারী গোলাবর্ষণে আকৃষ্ট করেছিল, যার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর সমস্ত মনোযোগই এক দিকে চলে আসায় বাকি কোম্পানিগুলো পাকিস্তানিদের অবস্থান বরাবর নির্বিঘ্নে আক্রমণ চালায়। এর পাশাপাশি দ্বিতীয় ধাপে সড়ক অক্ষ বরাবর ‘ডি’ কোম্পানির আক্রমণও পাকিস্তানি বাহিনীকে মিত্র বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে ভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল। যে সকল কারণে ৪৮ পাঞ্জাব হাল ছেড়ে দিয়ে গ্রেফতার হতে বাধ্য হয়েছিল। ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর এম এ সাঈদ নিহত হয়েছিলেন।
মূল অক্ষ বরাবর প্রথমদিকে মিত্র বাহিনীর এক প্লাটুনের আক্রমণ মিত্র বাহিনীর আক্রমণের প্রধান গতিপথ সম্পর্কে পাকিস্তানিদের কাছে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ধরা পড়ল। মিত্র বাহিনীর দফায় দফায় আক্রমণের পরিকল্পনা সম্পর্কে পাকিস্তানিদের ভ্রান্তিতে ফেলে দেয় দ্বিতীয় ধাপে একই অক্ষ বরাবর মিত্র বাহিনীর এক কোম্পানির আক্রমণ। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল মিত্র বাহিনী একসাথে একটা গোটা ব্রিগেড ওদের ওপর আক্রমণ করেছে। নীলফামারী মহকুমার দারওয়ানী রেলস্টেশনের দিকে পাঠানো মিত্র বাহিনীর ৫ গ্রেনেডিয়ারকে নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিল, ফলে মিত্র বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্র ধারণাও পায়নি। শেষদিকে পাকিস্তানিদের সাঁজোয়া বহর অক্ষত দেখে যথেষ্ট উদ্বেগ জন্মাল, বিশেষ করে যখন সরাসরি গোলার আঘাতে দুটি ট্যাংক চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়ে মিত্র বাহিনীর অচল সাঁজোয়া বহরের আকার এমনিতেই ছোট হয়ে গিয়েছিল। মিত্র বাহিনীর সাঁজোয়া বহরের আরো দুর্বলতা ছিল, আমাদের দুর্বল ট্যাংকগুলোর তুলনায় পাকিস্তানিদের ছিল উন্নততর কামান এবং অধিক সুরক্ষাদায়ক শ্যাফে ট্যাংক, যদিও মিত্র বাহিনীর গুলো ছিল অধিক চৌকস। এই পরিস্থিতিতে শ্যাফে ট্যাংকগুলো পাকিস্তানি ৬৯ ক্যাভেলরির একটা আস্ত ট্রুপ দখল করাটা যা-তা অর্জন ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁজোয়া বহরের কারণে সৃষ্ট এই বিপদ মিত্র বাহিনীকে পদাতিক বাহিনী একটি সাহসী এবং সূদৃঢ় আক্রমণ শানিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে দ্রুতই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। এখানে তারা একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাইলেন বিজয়ের জন্য। নীলফামারীর প্রান্তিক একটি গ্রামীণ জনপদে দিনের শেষভাগে সূর্যাস্তের আগে গোধূলিলগ্নে একটা মল্লযুদ্ধই হলো এবং ৪৮ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের প্রচুর সৈন্য মুহূর্তেই হতাহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, তা খরখড়িয়ার যুদ্ধে ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে থাকল।
নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সেনা সদস্য আর মুক্তিযোদ্ধারা আগ্রাসী হয়ে ধেয়ে আসছিল নীলফামারীর সৈয়দপুরের দিকে। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি সেনারা অবরুদ্ধপ্রায়। পাকিস্তানি মেজর শাফি বুঝতে পারলেন নীলফামারী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অন্তত প্রাণে বাঁচতে হলে আত্মসমর্পণের বিকল্প কিছু নেই। প্রাণে বাঁচতে হলে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। মেজর শাফি দ্রুতই উত্তরাঞ্চলীয় জিওসি মেজর জেনারেল নজর হোসেনের সাথে ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করে মিত্র বাহিনীর সাথে দেখা করার বিষয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। সে সময় মিত্র বাহিনীর ৭১ মাউন্টেন ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার পি এন কাথপালিয়া অবস্থান করছিলেন নীলফামারী মহকুমার অদূরেই দারওয়ানীতে।
মিত্রবাহিনীর উত্তর-পশ্চিমাংশের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম এল তপনের সাথে পরামর্শ গ্রহণ করে আত্মসমর্পণ বিষয়ে আলোচনা করার জন্য দারওয়ানীতে প্রেরণ করা হয় ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রধান জিওসি মেজর জেনারেল পি সি রেড্ডিকে। তিনি একটি হেলিকপ্টারে করে নীলফামারী মহকুমার দারওয়ানীতে পৌঁছার পর সেখানে পাকিস্তানি মেজর শাফি এসে আত্মসমর্পণ বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করেন। ভারতের কোচবিহার থেকে হেলিকপ্টারে দারওয়ানী এলেন ৬ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল পি সি রেড্ডি। আর এভাবেই ডোমার ৬ ডিসেম্বর, ডিমলা ১১ ডিসেম্বর, জলঢাকা ১২ ডিসেম্বর, নীলফামারী সদর ১৩ ডিসেম্বর, কিশোরগঞ্জ ১৫ ডিসেম্বর এবং ১৮ ডিসেম্বর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হানাদারমুক্ত হয় সমগ্র নীলফামারী মহকুমা। বিমানবাহিনীর বৈমানিক হওয়া সত্ত্বেও পদাতিক বাহিনীর ভূমিকায় উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য তিনি বীর-উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত হন।
১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর অনেক সদস্য যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন নীলফামারীর সবুজ প্রান্তরে। সে সকল বীর সেনাদের আত্মত্যাগ চিরোভাস্মর হয়ে রইবে। আমরা, সেই সকল সত্য আজও জানি না। মিত্রবাহিনীর বীরসেনাদের সম্পর্কে আমরা আসলে এখনো জানি না কিছুই। জানিনা বন্ধুর কৃষ্ণপক্ষে আর স্বৈরিণী শুল্কপক্ষে কী করে খুঁজে ফিরছে নেকড়ের পদচিহ্ন, কী করে প্রিয়জনের রক্ততরঙ্গে হাবুডুবু খেতে খেতেও অশ্রু মুছে অন্ধকারের চোখে চোখ রাখছে সবকিছু জানবার ঔদ্ধত্য থেকে তাই, দেখ, প্রতিবার চেষ্টা করি তোমাদের মূল্যায়ন করার। নিশ্চই আমরা নীলফামারীবাসী একদিন সম্মিলিত কণ্ঠে ক্ষমা চাইবো, যাদের জন্যই তোমরা জীবনকে বাজি রেখেছিলে নিরহঙ্কারের বুনোট দিয়ে তৈরি ঔদার্যমাখা চোখে।
লেখক: আইনজীবী, লেখক ও পিএইচ.ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়।