1269
Published on নভেম্বর 7, 2023আলীম হায়দার:
নভেম্বরের সন্ধ্যা। শীত শীত চারপাশ। হালকা কুয়াশা। আলো-আঁধারের খেলা। সেনানিবাসের ভেতরে শুরু হয় গোপন ফিসফাস। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে সেনাসদস্যদের একটি হঠকারী চক্র, বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের অনুগত ও পাকিস্তানফেরত পুনর্বাসিত সেনাদের একটি বড় অংশ। রাত ১২টার পর, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে বর্বরভাবে হত্যার অন্যতম হোতা মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে শুরু হয় গুলিবর্ষণ, হত্যা ও লুটপাট। বিশৃঙ্খলায় যোগ দেয় কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা।
৭ নভেম্বর, ১৯৭৫। অতর্কিত হামলা চালানো হয় সেনা কর্মকর্তাদের বাসভবনগুলোতে। প্রথম আক্রমণেই হত্যা করা হয় একজন নারী চিকিৎসকসহ ১৩ জন অফিসারকে। এমনকি সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরীর অসুস্থ স্ত্রীকে পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের সমর্থনপুষ্ট উচ্ছৃঙ্খল সেনারা। সেনা-বিশৃঙ্খলার শিকার হয়ে হতাহত হন শতাধিক সেনা-সদস্য। সকালে নির্মমভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের তিন জন পরাক্রমশালী সেক্টর কমান্ডারকে। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান।
মূলত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা, এরপর বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রুদ্ধ করতে ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর ও জাতীয় চার নেতাকে জেলের মধ্যে বর্বরভাবে হত্যা- এই দুটি কলঙ্কজনক ঘটনার পরম্পরায় ঐতিহাসিকভাবে সম্পৃক্ত ৭ নভেম্বরের মুক্তিযোদ্ধা বীর সেনানীদের হত্যাযজ্ঞ। সবগুলো ঘটনার সঙ্গেই রয়েছে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যা-মামলার সাক্ষী, খুনিদের সাক্ষাৎকার, সেনানিবাসে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আত্মজীবনী থেকে প্রতিটি ঘটনার পেছনেই জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এছাড়াও ১৯৭৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থান দমনের নামে প্রায় দেড় হাজার সেনা সদস্যকে বিনা-বিচারে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করে জিয়াউর রহমান। সেই ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারক হিসেবে যে কর্মকর্তারা থাকতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের কয়েকজন এবং যে সৈনিকরা ভাগ্যক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন, তারাও পরে সাক্ষাৎকারে সেইসব ভয়ার্ত রাত্রির বীভৎস স্মৃতির কথা প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমে।
৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক বাস্তবতা:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যার পর, সেদিনই সাংবিধানিক নিয়মের বাইরে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয় খন্দকার মোশতাক। ২৪ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় উপ-সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। এরপর দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বঙ্গভবনে অবস্থান করায়, চেইন অব কমান্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সেনাবাহিনীর ভেতরে। চাকরিরত কর্মকর্তাদের বঙ্গভবন থেকে সেনানিবাসে ফেরানো এবং বিচারের মুখোমুখি করার দাবি তোলেন মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের একটি বড় অংশ। কিন্তু চতুর জিয়া খুনিদের প্রতি কোনো ব্যবস্থা নিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। ফলে সিজিএস খালেদ মোশাররফ, ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সাফায়াত জামিল, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, সেক্টর কমান্ডার এটিএম হায়দার ও হুদার অনুগত সেনারা ৩ নভেম্বর প্রথম প্রহরে জিয়াকে গৃহবন্দি করে।
এরমধ্যেই জিয়ার অনুগত সেনাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে বন্দি জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান ও এইচএম মনসুর আলীকে হত্যা করান অবৈধ রাষ্ট্রপতি মোশতাক। এই তথ্য গোপন রেখে দেশত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। শুধু দেশে থেকে যায় ফিল্ড রেজিমেন্টের এক খুনি মেজর, এই লেখার শুরুতেই একবার তার নাম বলা হয়েছে, ৭ নভেম্বর সেনানিবাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে জিয়ার দক্ষিণ হস্তের ভূমিকা পালনকারী মেজর মহিউদ্দিন।
ফলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে ফিল্ড রেজিমেন্টে যায় জিয়া। এরপর পাকিস্তানফেরত সেনাদের সামনে উত্তেজক বক্তব্য দিয়ে বর্বরতার নেতৃত্ব তুলে নেয় নিজের হাতে। ফলে বীর সেনাদের প্রশিক্ষণের পবিত্র ঘামে ভেজা সেনা-প্রাঙ্গণ কলঙ্কের রক্তে পঙ্কিল হয়ে ওঠে । উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো ব্যাটেলিয়নই এই নাশকতার সঙ্গে ছিল না।
রাতভর চলে পাকিস্তানফেরত এবং জিয়ার অনুসারীদের নৃশংসতা। ৭ নভেম্বর দিনের বেলা জিয়াউর রহমানের নির্দেশে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও কে ফোর্সের প্রধান খালেদ মোশাররফ, সেক্টর কমান্ডার ও ক্রাক প্লাটুনের অন্যতম উদ্যোক্তা লে. কর্নেল এটিএম হায়দার ও সাব-সেক্টর কমান্ডার ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কর্নেল হুদাকে।
এরপর, মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যার তদন্ত ও বিচার নস্যাৎ করতেই ৭ নভেম্বর দিনটিকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে খুনি জিয়া। এই হত্যাযজ্ঞ এবং এরপর বিচার বানচালের জন্য নৃশংসতার পক্ষে দিবস পালন- এটি একটি ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ, এবং জিয়াউর রহমান এই পৈশাচিক চিন্তা ও কর্মধারার মাস্টারমাইন্ড।
বিপ্লব ও সংহতির নামে ইতিহাস বিকৃতি ও মিথ্যাচার:
মূলত, ৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীদের হত্যা করে জিয়াউর রহমানের অনুগত পাকিস্তানফেরত সেনারা। এরসঙ্গে জাসদের গণবাহিনীর একটা অংশের গোপন সম্পৃক্ততা ছিল, কিন্তু তারা এর ফল ভোগ করতে পারেনি। চতুর জিয়া প্রথম সুযোগেই জাসদ নেতা তাহেরকে ক্যাঙ্গারু কোর্টে ফাঁসি দিয়ে ৭ নভেম্বর নাশকতার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার সাক্ষ্যপ্রমাণ কবর দিয়ে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যায় জিয়ার ষড়যন্ত্রের সঙ্গী হওয়ার মাসুল জাসদকে দিতে হয়েছে অনেক চড়া মূল্যে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে। কারণ পরবর্তীতে শত শত জাসদ কর্মীকে জেল-জুলুম ও হত্যা করেছে জিয়াউর রহমানই।
একপর্যায়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া জাসদের খণ্ডাংশগুলো নিজেদের রাজনৈতিক ভুল ও বর্বরতাকে ঢাকার অপচেষ্টা হিসেবে, এই দিনটিকে সিপাহী বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপচেষ্টা চালিয়েছে। মূলত, কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে প্রতারণার দায় এড়াতে দেশের শ্রেষ্ঠ সেনা অধিনায়কদের নির্মম মৃত্যুর দিনকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে দেশের বামপন্থী রাজনীতিকদের এই অংশটি।
৭ নভেম্বর হত্যাযজ্ঞ নিয়ে সেসময়কার প্রত্যক্ষদর্শী ও সেনানিবাসে অবস্থানকারী একাধিক সামরিক কর্মকতার লেখা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দেশের মানুষ আগে থেকে সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে চিন্তাও করতে পারেনি। সেনানিবাসে সংঘটিত এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। এমনকি তারা এসব ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে জানতেও পারেনি, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা ছিল না জনগণের। এটিকে বিপ্লব বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিপ্লবের পটভূমি রচিত হয় গণমানুষের মধ্য থেকে। অথচ ৭ নভেম্বরের পূর্বাপরে গণমানুষের উপস্থিতি শূন্য।
এছাড়াও এই রক্ষাক্ষয়ী অভ্যুত্থানের সঙ্গে বেসামরিক সমাজের কেউ সংহতিও জানায়নি। ঢাকার রাস্তায় জাসদের কিছু ক্ষমতালোভী নেতা ছাড়া কোনো সাধারণ মানুষকে দেখাও যায়নি। বরং সেনানিবাসের ভেতরের এই হত্যাযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর, দেশজুড়ে বিরাজ করছিল এক থমথমে ভাব। কখন কী হয়, সেই উৎকণ্ঠায় সময় কাটিয়েছে গণমানুষ, এক ভয়াবহ আতঙ্কিত সময়।
৭ নভেম্বর: জাতির লজ্জা ও শোকের দিন
স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা বীর সেনানীদের হত্যার মাধ্যমে নিজের অবৈধ ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। একইসঙ্গে বাংলাদেশকে সরিয়ে নিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তথা জাতীয় চার নীতি ও সংবিধানের মূল চার স্তম্ভ থেকে। দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে কুখ্যাত রাজাকারদের, নিষিদ্ধ স্বাধীনতাবিরোধী উগ্রবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে দেয় রাজনীতিতে ফেরার অনুমতি, এমনকি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের সঙ্গে ৭ নভেম্বরের খুনিদের দায়মুক্তির বিষয়টি যোগ করে, ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে, চিরতরে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান।
তাই বলি কী, বিপ্লব-সংহতির শব্দের ফাঁদ ও বিকৃত ইতিহাসের অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে আসুন। ইতিহাস ঘাটুন, সত্য জানুন। টিকটক দেখে সময় নষ্ট না করে, তৎকালীন পত্রপত্রিকা ঘাটুন, রেফারেন্স পড়ুন। আপনি আলোকিত হবেন সঠিত তথ্যে, ইতিহাস আলোকিত হবে আপনাকে দিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে, ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি শোকের দিন। এই দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসের আরেকটি লজ্জাজনক ও কলঙ্কময় দিন। অথচ বিপ্লব ও সংহতির নামে ভয়ঙ্করভাবে এই ন্যাক্কারজনক ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা করে খুনি জিয়ার দল বিএনপি। ইতিহাস বিকৃতির দায়ে এই অপশক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: কবি; সদস্য, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।