1153
Published on আগস্ট 17, 2023সবকিছু ঠিক থাকলে ২০০৬ সালের শেষের দিকেই হওয়ার কথা ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু ২০০১ সালের অক্টোবরে সরকার গঠন করা বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতা ছেড়ে দিলে আর সুষ্ঠু ভোটে জিততে পারবে না জন্য দেশজুড়ে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায়। খালেদা জিয়ার পুরো শাসনামলজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর। সেই ধারাবাহিকতাতেই বিএনপি-জামায়াতের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলা চালায় উগ্রবাদী জঙ্গিরা।
মূলত, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জেএমবি ও হরকাত-উল-জিহাদসহ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে বিরোধী দল দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য তাদের কাছে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকবার এসব জঙ্গিদের আটক করলেও খালেদা জিয়া সরকারের নির্দেশে আবারো ছেড়ে দেওয়া হতো এই জঙ্গিদের। উদ্দেশ্য ছিল, আসন্ন নবম জাতীয় নির্বাচনে যেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রাণভয়ে ঘর থেকে বের না হয়; তাহলে পেশীশক্তি দেখিয়ে সাধারণ জনগণকে দাবিয়ে রেখে ভোট লুটের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতা দখলের নীলনকশা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট।
২০০৫ সালের ২০ আগস্ট জনকণ্ঠের খবরে দেখা যায়, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নওগাঁর বাসায় বৈঠকে বসে জঙ্গিরা। ১৭ আগস্টের বর্বর বোমা হামলার পর রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার নূর মোহাম্মদ বাংলা ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ চান। কিন্তু খালেদা সরকারের নির্দেশে ডিআইজি নূর মোহাম্মদকে অভিযান চালানো থেকে বিরত করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আমিনুল হক এবং প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির
তবে ১৭ আগস্টের বোমা হামলার পটভূমি রচিত হয়েছিল আরো অনেক আগে সরাসরি বিএনপি-জামায়াত সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায়।
২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানের বরাতে প্রথম আলো পত্রিকা জানায়, ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাই ট্রাকে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দিয়ে প্রায় ১৫০ জন জঙ্গি নিয়ে প্রকাশ্যে নাটোরের এমপি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৬ জুন আদালত এবিষয়ে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অর্থায়ন, আশ্রয়, প্রশ্রয়েই জেএমবি তাদের জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে।
সেবছরই ২৭ জুনের প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে বাংলা ভাইয়ের জন্য তদবির করে ফোন করেছিলেন প্রভাবশালী বিএনপি নেতা এবং খালেদা সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক।
২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর এবং ৪ অক্টোবরের জনকণ্ঠ পত্রিকার খবরে জানা যায়: কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থলে ৭৫ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, উদীচী ও রমনা বটমূলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা, ১৭ আগস্টের দেশব্যাপী বোমা হামলা- এতো নাশকতার পরেও বিএনপি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আশ্বাস থাকার কারণেই দেশ ছাড়েনি জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান।
জঙ্গি হান্নানকে আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে এক বিবৃতিতে হান্নানের বরাতে র্যাব জানায়, জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী মুফতি হান্নানকে ক্ষমা প্রার্থনার দরখাস্ত দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলেন।
২০০৫ সালের ৭ অক্টোবরের খবর থেকে আরো জানা যায়- জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানের বিচার স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ করেন খালেদা জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবতী, গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুর রহমান নান্টু এবং সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান পিনু।
জেনে অবাক হবেন, এই হামলাকারী জঙ্গিদের সবারই পরিবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এরা পারিবারিকভাবে রাজাকার ও জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিলের জনকণ্ঠের সংবাদ জানায়, জেএমবির শুরা সদস্যের সাত জনের সবারই ধর্মীয় রাজনীতির হাতেখড়ি শিবিরের মাধ্যমে। জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের বাবা ছিল ১৯৭১-এ জামালপুরের আল বদর কমান্ডার, তার নাম আবুল ফজল। শায়খ আবদুর রহমান নিজেও শিবিরের অগ্রগামী সংগঠন ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। পারিবারিকভাবে তার সঙ্গে জামায়াতের সব শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমানের ছোটভাই আতাউর রহমান সানি মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় ছিল শিবিরের সাথী, পরে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিবিরের অন্যতম প্রধান সাংগঠনিক নেতা হয়। ২০০০ সালের পর জেএমবির সামরিক শাখার দায়িত্ব নেয়।
জেএমবির আরেক অপারেশনাল কমান্ডার বাংলা ভাইয়ের আসল নাম সিদ্দিকুর রহমান। বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার মহিষবাথান ইউনিয়নের কর্ণিপাড়া গ্রামের রাজাকার নাজির হোসেনের ছেলে সে। ১৭ আগস্ট বোমা হামলার অন্যতম কুশীলব এই সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই বগুড়ার আযিযুল হক কলেজে শিবিরের একজন প্রভাবশালী নেতা ছিল। শহরের শিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতো সে।
২০০২ সালের ১৭ আগস্ট বাগেরহাটে আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টাকালে গ্রামবাসীরা বাংলা ভাইকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও, তারেক রহমানের হুকুমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের তদবিরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে জেএমবি। ২০০৩ সালের ১৪ আগস্ট জয়পুরহাট থেকে বাংলা ভাইসহ কয়েকজন জেএমবি সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক করা হলেও, হাওয়া ভবন সিন্ডিকেটের সুপারিশে আবারো ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
শুধু তাই নয়, ২০০৫ সালে বাংলা ভাইয়ের সহযোগী ও জেএমবি নেতা খামারু আটক হওয়ার পর, বাংলা ভাইয়ের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মাধ্যমে তার মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয় তারেক রহমান।
জেএমবির শুরা সদস্য নুরুল হুদা আবেদও ছিল একজন প্রভাবশালী শিবির নেতা। পরবর্তীতে শায়খ আবদুর রহমানের সঙ্গে জোট বেধে জেএমবি গঠন করে সে।
২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারী, রমনা বটমূল, উদীচী ও ১৭ আগস্ট সারাদেশে বোমা হামলার অন্যতম হোতা মুফতি হান্নান। তার ভাই মতিয়ার রহমান মতি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা।
জেএমবির মজলিসে শুরার সদস্য হাফেজ মাহমুদ ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে জেতাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল জেএমবির ক্যাডাররা। বিনিময়ে ক্ষমতায় গেলে তাদেরকে অনেক সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল হাওয়া ভবন থেকে।
২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সময়টাতে কমপক্ষে ১৪টি ভিন্নধারার উগ্রবাদী সংগঠনের ছদ্মবেশে দেশে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে জামায়াত-বিএনপি। জামায়াত-বিএনপির শক্তিতে ভর করেই দেশজুড়ে সশস্ত্র তৎপরতা চালায় জঙ্গিরা।