914
Published on আগস্ট 16, 2023২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে ৬৩টি জেলায় বোমা হামলা করে জঙ্গিসংগঠন জেএমবি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জেএমবি ও হরকত-উল-জিহাদসহ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে বিরোধী দল দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের জন্য তাদের কাছে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকবার এসব জঙ্গিদের আটক করলেও খালেদা জিয়া সরকারের নির্দেশে আবারো ছেড়ে দেওয়া হতো এই জঙ্গিদের। উদ্দেশ্য ছিল, আসন্ন নবম জাতীয় নির্বাচনে যেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রাণভয়ে ঘর থেকে বের না হয়; তাহলে পেশীশক্তি দেখিয়ে সাধারণ জনগণকে দাবিয়ে রেখে ভোট লুটের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতা দখলের নীলনকশা করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট।
তবে পরবর্তীতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় এবং বিএনপির দীর্ঘদিনের মাস্টারপ্লান বানচাল হয়ে যায়। তবে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের দেশজুড়ে ৬৩ জেলায় কমপক্ষে ৫০০ বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ২ জনকে হত্যা এবং প্রায় ৩০০ জনকে আহত করে বিএনপি-জামায়াতের মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। এই ঘটনার পর দেশের সাধারণ মানুষ ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ে। অথচ বিএনপি নেতাদের বাড়িতে সৌহার্দ্রপূর্ণ পরিবেশে চলতে থাকে জঙ্গিদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক। এমনকি শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেফতার না করতেও চাপ দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
২০০৫ সালের ২০ আগস্ট জনকণ্ঠের খবরে দেখা যায়, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর জোট সরকারের সরাসরি সমর্থনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে জেএমবির জঙ্গিরা। এরপর উত্তরাঞ্চলের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের সঙ্গে বৈঠকে বসে তারা। ১৭ আগস্টের বর্বর বোমা হামলার পর রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার নূর মোহাম্মদ বাংলা ভাইয়ের হাতে ইতোপূর্বের ১৭ হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ চান, কিন্তু সেই ১৭ খুনের দায়িত্ব কে নেবে বলে পুলিশের কাছে জানতে চান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আমিনুল হক এবং প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। এর জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, যারা এসব খুনের নির্দেশ দিয়েছেন তারাই দায়িত্ব নেবেন। এরপরেই বিএনপি-জামায়াত সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে বাংলা ভাইকে ধরার অভিযান থেকে বিরত করা হয় পুলিশের ডিআইজি নূর মোহাম্মদকে।
তবে ১৭ আগস্টের বোমা হামলার পটভূমি রচিত হয়েছিল আরো অন্তত দেড় বছর আগে। এসময়ের মধ্যে কমপক্ষে ২৪ জন স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের জেএমবি। এরপর দেশজুড়ে একটা বড় বিস্ফোরণের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয় জোট সরকারের রাষ্ট্রীয় মদতে।
২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুসন্ধানের বরাতে প্রথম আলো পত্রিকা জানায়, ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাই ট্রাকে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দিয়ে প্রায় ১৫০ জন জঙ্গি নিয়ে প্রকাশ্যে নাটোরের এমপি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করে। এছাড়াও, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার পর জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয় তৎকালীন উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা এবং রাজশাহীর তৎকালীন সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সাথে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৬ জুন আদালত এবিষয়ে বলেন রাজশাহীর বাগমারায় জেএমবির সূতিকাগার ছিল। আর হামিরকুৎসায় বাংলা ভাইয়ের টর্চার সেল ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বাগমারায় জেএমবির উত্থান ঘটে। তাদের অর্থায়ন, আশ্রয়, প্রশ্রয়েই জেএমবি তাদের জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে।
সেবছরই ২৭ জুনের প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে বাংলা ভাইয়ের জন্য তদবির করে ফোন করেছিলেন প্রভাবশালী বিএনপি নেতা এবং খালেদা সরকারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক।
২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর এবং ৪ অক্টোবরের জনকণ্ঠ পত্রিকার খবরে জানা যায়: কোটালিপাড়ায় জনসভাস্থলে ৭৫ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, উদীচী ও রমনা বটমূলে বোমা মেরে মানুষ হত্যা, ১৭ আগস্টের দেশব্যাপী বোমা হামলা- এতো নাশকতার পরেও বিএনপি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের আশ্বাস থাকার কারণেই দেশ ছাড়েনি জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নান।
জঙ্গি হান্নানকে আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে এক বিবৃতিতে হান্নানের বরাতে র্যাব জানায়, ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পরেও দেশ ছেড়ে না পালানোর কারণ হিসেবে সরকারের আশ্বাসের কথা বলেছে হান্নান। জোট সরকারের অন্যতম শরিক ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আলতাফ চৌধুরী তখন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য দরখাস্ত দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেন হান্নানকে।
২০০৫ সালের ৭ অক্টোবরের খবর থেকে আরো জানা যায়- জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানের বিচার স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ করেন খালেদা জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবতী, গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুর রহমান নান্টু এবং সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান পিনু।