755
Published on আগস্ট 16, 2023১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার অন্যতম কুশীলব ছিল তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরপর ২৩ আগস্টের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতারের পর, ২৪ আগস্ট সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হয় সে। এসময় সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শক্তির ওপর ভর করে ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি করে খন্দকার মোশতাক। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসনের অধীনে এক লোক দেখানো নির্বাচনে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার পর সংবিধান সংশোধন করে এই ঘৃণিত 'দায়মুক্তি অধ্যাদেশ'কে আইনে পরিণত করে জিয়াউর রহমান। এর মাধ্যমে জাতীয় চারনেতা হত্যার মতো বর্বর ঘটনাগুলোর বিচার করার সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় সে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করার আইনগত রাস্তাও বন্ধ করে দেয় তারা।
তবে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, সর্বসম্মতিক্রমে ১২ নভেম্বর এই অধ্যাদেশ বাতিল করা হয় জাতীয় সংসদে। ফলে খুলে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের রাস্তা। এরপর গ্রেফতার হয় কয়েকজন খুনি। বাকিরা আত্মগোপনে চলে যায়।
১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। একই বছরের ১২ মার্চ আদালতে বিচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে আপিলের পর আদালত ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
কিন্তু জানলে অবাক হবেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এই বিচার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি আওয়ামী সরকারের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে চাকরিচ্যুত কয়েকজন খুনিকে আবারো প্রমোশন দিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন খালেদা জিয়া। জেল থেকে মুক্তি দিয়ে খুনি খায়রুজ্জামানকে সরাসরি মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। এমনকি আওয়ামী লীগের সময়ে জিম্বাবুয়েতে পালিয়ে থাকা অবস্থায় চাকরিচ্যুত ও পরবর্তীতে সেখানেই মারা যাওয়া আরেক খুনি আজিজ পাশাকে মরণোত্তর প্রমোশন দেওয়ার অবিশ্বাস্য নজির গড়া হয়েছে খালেদা জিয়ার সরাসরি নির্দেশে।
১৯৯১ সালেও খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকার সময় খুনি রাশেদ চৌধুরী ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরি দেন। খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় এসময় খুনি ফারুক-রশিদ-বজলুল হুদারা ফ্রিডম পার্টির নামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে দেশে, বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা।
তবে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ফলে বিএনপি-জামায়াতের নির্দেশে ২০০১ সাল থেকে থেমে থাকা বিচারপ্রক্রিয়া আবারো শুরু হয়। উচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে ১২ আসামির ফাঁসির রায় বহাল থাকে। ২০১০ সালে খুনিদের মধ্যে পাঁচ জনকে ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরপর ২০২০ সালে আরো এক জন দণ্ডিত খুনিকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছে। বাকি পাঁচ জন ফাঁসির আসামি আত্মগাপন করে বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। তাদের খুঁজে দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার।
অথচ, বঙ্গবন্ধু হত্যার সময়ই একজন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান জানতো যে, খন্দকার মোশতাকের ৮৩ দিনের রাষ্ট্রপতিত্বের সবকিছুই অবৈধ। কারণ,তার প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণই ছিল অবৈধ, ফলে তার অধ্যাদেশও বৈধতা পায় না। সংবিধান অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কারা অন্তরালে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করার পর সংবিধান অনুযায়ী স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা। অথচ তারা সবাই নিজপদে বহাল থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ অবৈধভাবে জিয়াউর রহমানের অনুগত অস্ত্রধারী সেনাসদস্যদের সহায়তায় বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক সরাসরি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়! সংবিধান চালু থাকা অবস্থায় কোনো এটি আইনেই বৈধতা পায় না। মূলত খন্দকার মোশতাক ছিল স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি, যার পেছনে ছিল জিয়াউর রহমানের সামরিক শক্তি।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা এবং তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা প্রদান এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য নটরাজের ভূমিকা পালন করেন। ২০০১ সালে সরকার গঠনের পরেই তিনি থামিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার। এমনকি যারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যায় জড়িত তাদের অনেকের হাতে বিএনপির দায়িত্বও তুলে দেন তিনি।
২০০৪ সালের ১৬ এপ্রিল প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত জাতীয় চার নেতা হত্যার বিষয়ক প্রতিবেদনে সিমিন হোসেন রিমির সাক্ষ্য থেকে জানা যায়- বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান ধানমন্ডির একটি বাড়িতে আত্মগোপনের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু কে এম ওবায়দুর রহমান তাকে আশ্বাস দিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। এরপর তাকে গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ৩ নভেম্বর কারান্তরীণ অবস্থায় তাকেসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের বাহিনী। জেল হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল কে এম ওবায়দুর রহমান। কিন্তু ২০০৪ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত সরকারে থাকার সময় তাকে খালাস দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার পুরস্কার হিসেবে এই ওবায়দুর রহমানকে মন্ত্রী এবং বিএনপির মহাসচিব বানায় জিয়াউর রহমান। এর আগে, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের পদে থাকা অবস্থায় ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতির কারণে পদ হারাতে হয়েছিল তাকে। এরপর ক্ষমা চেয়ে ফের দলে ফিরলেও সুযোগ পেয়েই ঘাতকদের সাথে হাত মিলিয়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের টার্গেট করে নিধনযজ্ঞ চালাতে জিয়াউর রহমানের ডান হাত হয়ে ওঠে সে। বর্তমানে তার মেয়ে শামা ওবায়েদও একজন বিএনপি নেত্রী। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দেশবিরোধী গুজব, অপপ্রচার এবং বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা চালিয়ে আসছে সে।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলার কারাবন্দি আসামি খায়রুজ্জামানকে মুক্তি দেন। ২০০৩ সালের ৪ মে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
জেলহত্যা মামলার সাক্ষ্য থেকে ১৪ এপ্রিল প্রথম আলো পত্রিকা আরো জানায়: ২০০৪ সালে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে থাকা এবং পরবর্তীতে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা শমসের মবিন চৌধুরী জানান, ১৯৭৬ সালের এপ্রিল বা মে মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী তাকে একটি তালিকা দেন এবং বলেন তালিকার সেনাকর্মকর্তাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তালিকার সদস্যরা (বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার খুনিরা) ছিল লিবিয়াতে, সেখানেই তাদের নিয়োগপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়। নুর ও ডালিম লন্ডনে থাকায় তাদের নিয়োগপত্র লন্ডনে পৌঁছে দেওয়া হয়। মূলত সেনাপ্রধান ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়াউর রহমানই তখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছিল। তার নির্দেশেই এই খুনিদের পুর্নবাসন করা হয়েছিল।
এদিকে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সময় এই খুনিরা অবাধে দেশে যাতায়াত করতে থাকে। এমনকি ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে হত্যাচেষ্টার সময়ও খালেদা জিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে ঢাকায় অবস্থায় অবস্থান করছিল খুনি নুর। হত্যার মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর দ্রুত দেশত্যাগ করে সে। এছাড়াও মাঠে থেকে এই হামলা পরিচালনাকারী খালেদা জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং বর্তমান যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দীনকে সরকারি চ্যানেল ব্যবহার করে নিরাপদে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় মাস্টারমাইন্ড তারেক রহমান। এরপর খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতারা এই হামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য জজমিয়া নাটক সাজায়। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিরপেক্ষ তদন্তে বিএনপি-জামায়াতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আদ্যোপান্ত উঠে আসায় চমকে যায় বাঙালি জাতি।