রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা: খালেদা জিয়া ও বিএনপি সরকারের অপকর্মের আদ্যোপান্ত

1811

Published on জুলাই 18, 2023
  • Details Image

২০০১ সালের অক্টোবর, সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে ভোটারদের মনে ভীতি সৃষ্টি; ভোটকেন্দ্র দখল এবং ব্যালটবাক্স লুট করে ক্ষমতায় যায় বিএনপি-জামায়াত জোট। সরকার গঠনের পরপরই উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যানুসারে, বিএনপি সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষতায় ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নামে প্রায় অর্ধশতাধিক জঙ্গি সংগঠনের বিস্তার ঘটে বাংলাদেশে। জেএমবি জঙ্গি এবং বাংলা ভাইদের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের পুলিশ গ্রেফতার করলেও, বিএনপির মন্ত্রী-এমপিদের সরাসরি সুপারিশে তারা বারবার ছাড়া পেয়ে যায়।

এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র এবং বিএনপি নেতা তারেক রহমান নিজে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এসব জঙ্গিদের একাধিকবার ছাড় করিয়ে নেন। ফলে প্রকাশ্যে একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালাতে চালাতে দেশকে জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে উগ্রবাদী সন্ত্রাসী এবং নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো।

বিএনপি-জামায়াত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার জঙ্গিদের কাছে নিয়মিত অর্থ পৌঁছে দিতেন। এমনকি পুলিশের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে দুর্গম অঞ্চলেও জঙ্গিদের কাছে টাকা ও অ্যাসাইনমেন্ট পৌঁছে দেওয়া হতো বিএনপি-জামায়াত সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে। কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব জঙ্গিদের আটক করলেও, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সুপারিশ করে দুর্বল মামলা দিয়ে এদের আবারো দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। পুলিশের ব্যাকআপের সরাসরি এসব জঙ্গিদের সঙ্গে বৈঠক করতেন বিএনপি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এমপি-মন্ত্রীরা। শুধু তাই নয়, এসব জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কারণে খালেদা জিয়া সরকারের রোষে পড়ে চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়েছিল অনেক দেশপ্রেমী আইনরক্ষা বাহিনীর সদস্য ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার।

যেভাবে জঙ্গিদের জন্য অর্থ এবং পুলিশের ব্যাকআপ নিশ্চিত করতো খালেদা জিয়ার সরকার:

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিষয়ে ২০০৭ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৬ জুন আদালত বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মাধ্যমে জেএমবির উত্থান ঘটে। সরকারের সরাসরি অর্থায়ন এবং আশ্রয়-প্রশ্রয়েই জেএমবি তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। ২৭ জুনের প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদনে জঙ্গি পালনে বিএনপি সরকারের ভূমিকার ব্যাপারে আরো বলা হয়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে বাংলা ভাইয়ের জন্য তদবির করে ফোন করেছিলেন তার মন্ত্রী আমিনুল হক।

২০০৭ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে শায়খ আবদুর রহমান এবং বাংলা ভাই ট্রাকে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে দিয়ে প্রায় ১৫০ জন জঙ্গি নিয়ে প্রকাশ্যে নাটোরের এমপি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করে। এসময় বিএনপি নেতা দুলু তাদের জঙ্গি কার্যক্রমে খুশি হয়ে নগদ তিন লাখ টাকা উপহার দেয়। এছাড়াও, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী বোমা হামলার পর জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হয় তৎকালীন উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা এবং রাজশাহীর তৎকালীন সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সাথে। পরবর্তীতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বাংলা ভাই জানায়- বিএনপির সংসদ সদস্য আবু হেনা তার ভাতিজার মাধ্যমে জেএমবির সাথে নিয়মিত যোগযোগ রক্ষা করে চলতো, জঙ্গি কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য এক কর্মীর মাধ্যমে তাকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা উপহার দিয়েছিলেন রাজশাহীর মেয়র মিজানুর রহমান মিনু।

এমনকি সন্ত্রাসবাদ অব্যাহত রাখার জন্য পুঠিয়া থানার ওসি আনিসুর রহমানের হাত দিয়ে বাংলা ভাইয়ের কাছে ৩০ হাজার টাকা অনুদান পাঠিয়েছিল বিএনপির সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা। গোয়ালকান্দি পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে ওসি নিজে এই টাকা বাংলা ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়। এসময় সার্কেল এএসপি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

আটক হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান জানায়, রাজশাহীর বাগমারায় অভিযানের সময় তৎকালীন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের সাথে যোগাযোগ হয়েছিল তার। তিনি বিএনপির নেতাদের নির্দেশ দিয়ে জেএমবিকে সাহায্য করতে বলেছিলেন। স্থানীয় বিএনপি নেতারা পরে এই ঘটনার কথা স্বীকার বলে বলেছেন- খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় মন্ত্রী আমিনুল হকের কথার বাইরে যাওয়ার সামর্থ তখন কারো ছিল না।

এমনকি তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী নওগাঁর আলমগীর কবিরের সাথেও নিয়মিত কথা হতো এবং তার বাসায় দাওয়াত খাওয়ার কথাও জানিয়েছে বাংলা ভাই। এছাড়াও নওগাঁর এমপি শামসুল প্রমাণিক এবং প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ড. ছালেক চৌধুরীর সাথে নিয়মিত মোবাইলে ফোনে যোগাযোগের কথাও স্বীকার করেছে বাংলা ভাই ও শায়খ রহমান।

তারা জানায়, বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বিভিন্ন হামলার জন্য বিএনপি নেতাদের সহযোগিতার এতো অর্থ উঠেছিল যে, দীর্ঘদিন ধরে অভিযান শেষ করার পরেও সাত লাখ টাকা বেশি হয়েছিল। এ বিসয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শিশ মোহাম্মদও খালেদা সরকারের মন্ত্রী আমিনুরের নির্দেশে জেএমবি ও বাংলা ভাইকে সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করেছেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে।

খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রীদের চাপের কারণে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যও বাধ্য হয়েছিল জঙ্গিদের সহযোগিতা করতে। এমনকি গ্রেফতারের পরও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের হাই-কমান্ডের নির্দেশে তাদের ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২০০৫ সালে জেএমবি নেতা ও বাংলা ভাইয়ের সহযোগী খামারু আটক হওয়ার পর, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের মাধ্যমে তার মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয় তারেক রহমান। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার জুডিথ চামাসের পাঠানো গোপন তারবার্তা ফাঁস হওয়ার পর উইকিলিকস জানায়, খালেদা জিয়া মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে তারেকের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানিয়েছিলেন জুডিথকে।

এরআগে, ২০০২ সালের ১৭ আগস্ট বাগেরহাটের মোল্লাহাটে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও তার কন্যাকে হত্যাচেষ্টার সময় এলাকাবাসী জঙ্গি নেতা বাংলা ভাইকে আটক করে পুলিশে দেয়। তখন চার সপ্তাহ বাগেরহাট জেলহাজতে ছিল বাংলা ভাই। কিন্তু বগুড়ায় বাড়ি হওয়ায় তারেক রহমানের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় বিএনপি সরকারের নির্দেশে ছাড়া পায় সে। এরপর ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা ফাটায় জেএমবি। এই ঘটনায় ১৯ জন নিরীহ মানুষ মারা যায় এবং শতাধিক আহত হয়। কিন্তু জঙ্গিদের আটক না করে তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগের নেতা ও দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবীদের আটক করে হয়রানি করতে শুরু করে।

২০০৩ সালের ১৪ অগস্ট জয়পুরহাটের খেতলাল উপজেলার উত্তর মহেশপুর গ্রামে পুলিশের একটি দল অভিযানে গেলে, জেএমবির জঙ্গিরা হামলা করে পুলিশের তিনটি অস্ত্র, একটি ওয়্যারলেস সেট ও বেশ কিছু গুলি ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। বাংলাভাইসহ জেএমবির অনেক নেতাকর্মী আটক হলেও বিএনপি-জামায়াতের সরকারের বদৌলতে কয়েক মাসের ব্যবধানে তারা জামিনে বেরিয়ে যায়।

২০০৫ সালের ২০ আগস্ট জনকণ্ঠের খবরে দেখা যায়, ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর খালেদা জিয়া সরকারের সরাসরি সমর্থনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে জেএমবির জঙ্গিরা। এরপর উত্তরাঞ্চলের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের সঙ্গে বৈঠকে বসে তারা। এমনকি রাজশাহীর পুলিশে কমিশনার নূর মোহাম্মদ বাংলা ভাইয়ের হাতে ১৭ হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযানের নির্দেশ চান, কিন্তু সেই ১৭ খুনের দায়িত্ব কে নেবে বলে পুলিশের কাছে জানতে চান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আমিনুল হক এবং প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। এর জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, যারা এসব খুনের নির্দেশ দিয়েছেন তারাই দায়িত্ব নেবেন। এরপরেই বিএনপি-জামায়াত সরকারের শীর্ষ মহলের নির্দেশে বাংলা ভাইকে ধরার অভিযান থেকে বিরত করা হয় পুলিশের ডিআইজি নূর মোহাম্মদকে।

এমপি-মন্ত্রীদের মাধ্যমে দেশজুড়ে বিএনপি সরকারের জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালনা এবং বীভৎসতা:

গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মতিয়ার রহমান মতির ভাই জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানকে দিয়ে ২০০৫ সালে বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যারও চেষ্টা করেছিল বিএনপি সরকার। রমনা বটমূল, উদীচী ও সারাদেশে বোমা হামলার অন্যতম হোতা মুফতি হান্নানের ভাই মতিয়ার রহমান সরাসরি তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার কাছ থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করে তা ছোট ভাইকে অ্যাসাইনমেন্ট দিতো এবং কাজ শেষে নিয়মিত রিপোর্ট পেশ করতো বিএনপি সরকারের হাইকমান্ডের কাছে।

তারেক রহমানের টার্গেট ছিল দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে সাধারণ মানুষদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি লিস্ট ধরে ধরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা করা। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্টাইলে দেশের প্রগতিশীল শিক্ষক, বৃদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিচারক, পেশাজীবী, সংস্কৃতি কর্মীদের হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে দেশকে পাকিস্তানিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া। এলক্ষ্যে ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেই জঙ্গিগ্রুপগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বিএনপি। পরবর্তীতে দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় আটকের পর জেএমবির মজলিসে শুরার হাফেজ মাহমুদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে জেতাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল জেএমবির ক্যাডাররা। বিএনপির পক্ষ থেকেও ক্যাডারভিত্তিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল তাদের কাছে।

২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের জনকণ্ঠ পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সময়টাতে কমপক্ষে ১৪টি ভিন্নধারার উগ্রবাদী সংগঠনের ছদ্মবেশে দেশে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে। আধুনিক সমরাস্ত্রসহ একটি বড় জঙ্গিদলকে গ্রেফতারের পরেও সরকারে থাকা জামায়াত নেতাদের চাপে তাদের ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে চার্জশিট না দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ।

২০০৫ সালের ৮ এপ্রিলের খবরে দেখা যায়, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে বোমাবাজ জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানের হরকত-উল-জিহাদের সদস্যদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বিএনপি নেতাদের সরাসরি নেতৃত্বে। বিএনপি নেতা মাওলানা আবদুল খালেকের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন থেকে জঙ্গিদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছিল বলে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন মোড়েলগঞ্জ থানা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক খান আলতাফ হোসেন ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শামছুল আলম তালুকদার।

২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর এবং ৪ অক্টোবরের পত্রিকার খবরে জানা যায়: গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে ৭৫ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা, উদীচী, রমনা বটমূল, ১৭ আগস্টের দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় নিষিদ্ধ হরকত-উল-জিহাদের প্রধান মুফতি হান্নানকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করলে, তা নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে বিএনপি-জামায়াতের এমপি-মন্ত্রীরা। কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মতিয়ার রহমান মতির ভাই জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানকে নিতান্তই সরজ-সরল মানুষ বলে দাবি করে বিএনপি সরকার। এমনকি বিএনপির সংসদ সদস্যরা দাবি করেন যে, আওয়ামী লীগ নিজেরাই বোমা পুঁতে রেখে নিস্পাপ হরকত উল জিহাদের ওপর চাপাচ্ছে! অথচ আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে হান্নান জোট সরকারের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা জানায়।

অথচ ১ অক্টোবর জঙ্গি হান্নানকে আটকের পর তাৎক্ষণিকভাবে র্যাব জানায়, ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পরেও দেশ ছেড়ে না পালানোর কারণ হিসেবে খালেদা জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা বলেছে হান্নান। জোট সরকারের অন্যতম শরিক ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা মুহিউদ্দিন খান তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। আলতাফ চৌধুরী তখন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য দরখাস্ত দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেন হান্নানকে।

২০০৫ সালের ৭ অক্টোবরের খবর থেকে জানা যায়- জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানের বিচার স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি বরাবর সুপারিশ করেন খালেদা জিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট গৌতম চক্রবতী, গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুর রহমান নান্টু এবং সিনিয়র সহসভাপতি মনিরুজ্জামান পিনু।

২০০৫ সালের ১৭ জুলাইয়ের সংবাদ থেকে জানা যায়, নওগাঁয় অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যের পুত্র আওয়ামী লীগ কর্মী জিয়াউল হককে হত্যা করে বাংলা ভাইয়ের ক্যাডার শরিয়তুল্লাহ সীমার। কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নির্দেশে পুলিশ চার্জশিট থেকে তার নাম গোপনে বাদ দিয়ে দেয়। রানীনগর থানার ওসি মোহসীনুল হক এই তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেন সাংবাদিকদের কাছে। স্থানীয়রা এই ঘটনার পর জঙ্গিদের গডফাদার বিএনপি নেতা আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলো ধিক্কার জানায়।

২০০৫ সালের ২ অক্টোবরের আরেকটি খবরে দেখা যায়, নওগাঁর রানীনগর উপজেলার দেউলা গ্রামে বাংলা ভাইয়ের ক্যাডার গোবরার হাতে ধর্ষণের শিকার হয় স্থানীয় এক গৃহবধূ। কিন্তু বাংলা ভাইয়ের অন্য ক্যাডার শহীদুল ও মান্নানের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের সুসম্পর্ক থাকায় তারা ধর্ষক গোবরাকে গ্রেফতার না করার জন্য থানাকে চাপ দেয়।

২০০৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জনকণ্ঠে দেখা যায়, নওগাঁর চরমপন্থী ক্যাডার লাকীকে গ্রেফতারের পরেও ধরে রাখতে পারেনি পুলিশ। কারণ তারেক রহমানের ঘনিষ্ট প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নির্দেশে তার বাহিনীর লোকেরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে লাকীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এমনকি এরপর থেকে লাকীকে নিজ গাড়িতে নিয়ে মহড়া দিতো এই বিএনপি নেতা।

২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় আরো দেখা যায়, জঙ্গিদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে উগ্রবাদী জঙ্গিরা দেশের ৪টি আদালতে হামলা চালায়। চট্টগ্রাম, লক্ষীপুর, রংপুর ও চাঁদপুরের আদালতে তাদের বোমার আঘাতে মারা যান ২ জন, বিচারকসহ আহত হন অর্ধশত ব্যক্তি। এই ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও তারেক রহমানের ডান হাত বলে পরিচিত বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর নির্লজ্জের মতো বলেন, এমন আশঙ্কাই করেছিলাম!

২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সংবাদে জানা যায়- দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পর্ক এতোটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে, কোথাও জঙ্গি ধরা পড়লে এমপি-মন্ত্রীরা সরাসরি ফোন দিয়ে সেই জঙ্গিকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। সরকারি অফিসে চাঁদাবাজি, স্কুলে বোমা রাখা প্রভৃতি বিষয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে জামালপুরের সড়িষাবাড়ী উপজেলায় জঙ্গি ধরতে যায় পুলিশ। তখন স্থানীয় এমপি ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতারা অভিযান চালাতে নিষেধ করে বলেন- তাদের এলাকায় কোনো জঙ্গি ধরা যাবে না!

দেশজুড়ে জঙ্গিবাদ বিস্তারে তারেকের নেতৃত্বে খালেদা সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা:

২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিস্ট ব্রাঞ্চের তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের অদৃশ্য পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাইসহ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো নাশকতা পরিচালনা করে বাংলাদেশে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চার সদস্যের টিম বাংলাদেশে সরেজমিনে তদন্তের পর এই প্রতিবেদন দেয়। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর ওপর সিলেটের মাজারে বোমা হামলার ঘটনা তদন্ত করতে এসে তারা এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে।

২০০৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির খবরে পুলিশের বরাতে জানা যায়, আড়াই বছরে তিন শতাধিক উগ্রবাদি জঙ্গিকে অবৈধ বোমা-অস্ত্র-দলিল-দস্তাবেজসহ গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে সব প্রমাণ থাকার পরেও তারা পরে অজ্ঞাত কারণে ছাড়া পেয়ে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব জঙ্গিদের কৌশলে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। এবিষয়ে কোনো পুলিশ সদস্য আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা আরো জানান, রাজশাহী এলাকা থেকে বাংলা ভাইয়ের ৬২ জন ক্যাডার, উত্তরাঞ্চল থেকে জেএমবির ৫৯ জন জঙ্গি, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লা থেকে হিযবুতের ২২ জনকে, ফদিরপুর থেকে ১৮ জনকে; এছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা, বগুড়া, গাইবান্ধাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আরো দুই শতাধিক জঙ্গিকে আটক করে পুলিশ। তবে তাদের কাউকেই ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তেলেসমাতিতে বাংলা ভাইয়ের ৬২ জন জঙ্গির সবাই খুব স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বের হয়ে যায়, যা যে কোন আইনি প্রক্রিয়ার জন্য এক ব্যতিক্রম ঘটনা।

২০০৬ সালের ১১ মার্চের সংবাদে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের নির্দেশে প্রশাসনের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহী-নওগাঁর বিস্তৃত অঞ্চলে নৃশংস সন্ত্রাস চালায় বাংলা ভাইয়ের জঙ্গিরা। জেএমবির দুই শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমান প্রকাশ্যে বিএনপির এমপিদের বাসা, ইউপি চেয়ারম্যানের অফিস, সরকারি দফতর এবং অফিস-আদালতে গিয়ে বৈঠক করতো। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাগমারা ও নওগাঁর রানীনগর ইউপি ভবনে বসে প্রকাশ্যে নাশকতার পরিকল্পনা করে শীর্ষ জঙ্গিরা। এসব বৈঠকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও উপস্থিত থাকতো। দেশের শীর্ষ গণমাধ্যমে ছবিসব এসব বৈঠকের সংবাদ ছাপা হয়েছিল।

২০০৫ সালের ১৯ মার্চের খবরে জানা যায়, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যার পর জঙ্গিরা সরকারে থাকা ক্ষমতাশীন বিএনপি নেতাদের সঙ্গে রাতভর বৈঠক করে তাদের আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত করার দেনদরবার করতো। নওগাঁর বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের মাস্টারপাড়ার বাসভবনে তার ভাই আনোয়ার হোসেন বুলু ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে জেএমবির কমান্ডার ও জঙ্গিবাদী নেতা ড. গালিবের অনুসারীরা। আওয়ামী লীগ কর্মী জিয়া হত্যার মূল দুই হোতা জঙ্গি মোস্তাফিজুর রহমান খাজা ও শরিয়তুল্লাহ সীমার, আবদুস সালাম; একডালা ইউপি বিএনপির সভাপতি মোহন চেয়ারম্যান, সহসভাপতি আজিজার রহমান, সাধারণ সম্পাদক আকবর মেম্বার রাতভর ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিল। এ ব্যাপারে পুলিশ জানায়, সরকার সমর্থিত ব্যক্তি ও স্থানীয় গডফাদারদের শরণাপন্ন হওয়ায় জঙ্গিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করে ত্রাস ছড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে।

২০০৫ সালের ২৩ জুলাই জনকন্ঠের খবরে পুলিশের বরাতে জানা যায়, রাজশাহী থেকে গ্রেফতার বাংলা ভাইয়ের অনুগত ১১ জেএমবি জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তারা তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপি সরকারের প্রধান জোটসঙ্গী জামায়াতের নাম বলেছে। এছাড়াও বাংলা ভাইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান ও সৌদি আরব থেকে তাদের অর্থের সংস্থান হয় বলেও জানায় তারা।

দেশজুড়ে জঙ্গি কার্যক্রমের অন্যতম হোতা, বাংলা ভাইয়ের সহকারী ও বোমা বিশেষজ্ঞ আসাদুল্লাহ গালিব রাজশাহীতে ১৭ ফেব্রুয়ারি (২০০৫) প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করে। এসময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন খুলনার জামায়াত দলীয় এমপি আবদুল খালেক ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনু। এসময় বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতারা গালিব ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার কোনো সম্পর্ক নাই বলে সার্টিফিকেট প্রদান করে।

২০০৫ সালের ২ অক্টোবর জনকণ্ঠের সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ক পরিচালনা হতো বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়া থেকে। তারেক রহমানের গ্রিন সিগন্যাল থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় বসে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালাতে থাকে জঙ্গিরা। গাবতলী, কাহালু, নন্দীগ্রাম, সারিয়াকান্দি, শেরপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রামে জেএমবির জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এছাড়াও বগুড়ার উপকণ্ঠে বিভিন্ন মেস ও বাড়িতে ছদ্মবেশে সারাদেশ থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ক্যাডাররা এসে আশ্রয় নেয়।

২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের খবর থেকে জানা যায়, বগুড়ায় তারেক রহমানের আশীর্বাদপুষ্ট সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাইয়ের বাড়িকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয়। বিশেষ করে গাবতলীর কয়েকটি গ্রাম, একটি হাটের পাথার ও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে এসব জঙ্গিদের ট্রেনিং, বোমা বানানোর স্কোয়াড, মহিলা ক্যাডার তৈরির মূল কার্যক্রম চালানো হতো। গাবতলীর গোলাবাড়ি থেকে গ্রেফতার জঙ্গি ক্যাডার রাজ্জাক ওরফে হাসান এসব তথ্য জানায়। রাজ্জাক জানায়, ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলার অংশ হিসেবে বগুড়ায় সেসহ আরো কয়েকজন জঙ্গি রিকশা চালকের ছদ্মবেশে নাশকতায় অংশ নিয়েছিল।

২০০৬ সালের ২ এপ্রিলের জনকণ্ঠ পত্রিকার সংবাদে দেখা যায়, দেশে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সন্ত্রাসীদের পরিবারের অধিকাংশই জামায়াত ও জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিএনপির এমপি-মন্ত্রীরা নাশকতামূলক কার্মকাণ্ড ও আওয়ামী লীগ দমনের জন্য সরাসরি এই জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কক্সবাজার সদর আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মো. শহীদুজ্জামানের উপস্থিতিতে বিএনপির সভায় জেএমবির ক্যাডার জাবেদ ইকবাল ওরফে মুহাম্মদের মুক্তির জন্য দোয়া করা হয়। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা, বিচারপতি হত্যা এবং চট্টগ্রাম আদালতে বোমা হামলার প্রধান আসামি এই জাবেদ ওরফে মুহাম্মদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় জেমবির কমান্ডার ছিল। তার পিতা তৎকালীন জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নেতা মাওলানা আবদুল আউয়াল।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী জেএমবির হামলার পর বিএনপি সরকারের সঙ্গে তাদের গোপন আঁতাত কোনোভাবেই গোপন রাখা সম্ভব ছিল না। নির্যাতন, হত্যা ও লুটের শিকার পরিবারগুলো সরাসরি বিএনপি-জামায়াত সরকারের ছত্রছায়ায় জেএমবি ও বাংলা ভাইয়ের সন্ত্রাস পরিচালনার তথ্য ফাঁস করে দিতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই খালেদা জিয়ার তিন মন্ত্রী, এক এমপি এবং রাজশাহীর মেয়রের নাম উঠে আসে। নওগাঁর রাণীনগর ও ভোপাড়ার ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বিএনপি নেতা ও প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির তাদের নামে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নের জন্য জঙ্গিদের লেলিয়ে দিয়েছিল।

২০০৬ সালের ১৫ জুনের সংবাদে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে নওগাঁ অঞ্চলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালায় জেএমবির জঙ্গিরা। এমনকি আত্রাই-রানীনগরের সংখ্যালঘু যুবকদের ভয় দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে তারা। এসব নির্যাতন ও একজন সাবেক সেনাসদস্যকে হত্যার ঘটনায় জেএমবি সন্ত্রাসী রুস্তমের বিরুদ্ধে মামলা হলেও প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবিরের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানান, প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সথ্যের কারণে জঙ্গিনেতা শায়খ আবদুর রহমানের জামাতা আবদুল আউয়াল ১৭ আগস্টের বোমা হামলার পর দীর্ঘদিন আত্রাইয়ের ভরতেতুলিয়া গ্রামে রুস্তমের চাচা খলিলুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয়ে ছিল। রুস্তম ও তার চাচাতো ভাই মোয়াজ্জেম প্রতিমন্ত্রীর সরাসরি শেল্টারে জেএমবির কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

২০০৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বরের সংবাদ জানায়, সারাদেশে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত খুলনা অঞ্চলের জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসী কামরুলকে গ্রেফতারের পরও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় র্যাব। কারণ এই কামরুলের বাবা মাওলানা আব্দুল ওহাব হলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আধ্যাত্মিক গুরু। সাঈদীর সরাসরি সুপারিশে স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে মুক্তি দেওয়া হয় কামরুলকে।

২০০৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদে দেখা যায়, জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী নিধনের অংশ হিসেবে রাজশাহীর বাগমারায় ২২ জন ব্যক্তিকে হত্যা করে বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি বাহিনী, গুম করে ১০ জনকে, অমানুষিক নির্যাতনে আহত ও পঙ্গু হয় শতাধিক। এমনকি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় সহস্রাধিক মানুষ। নওগাঁর রানীনগরের আবদুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যার পর বগুড়ার নন্দীগ্রামে নিয়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা এবং মায়ের সামনে আত্রাইয়ের ছাত্রলীগ নেতা খেজুর আলীকে চার টুকরো করে পুঁতে ফেলার ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশের পরও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলা ভাইকে নির্দোষ এবং সরকার সমর্থিত টেলিভিশনে তাকে শান্তির দূত বলে দাবি করেছে।

বাংলা ভাইয়ের সহকারী ড. গালিব এবং তার ভাগ্নে বোমারু মহসীন তিন বছরের বেশি সময় ধরে রাজশাহী অঞ্চলের মসজিদকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটালেও কখনো তাদের গ্রেফতার করেনি পুলিশ। উল্টো বিএনপি ও জামায়াতের এমপি-মন্ত্রী-মেয়রেরা তাদের ক্লিনচিট দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিযান চালানো থেকে নিবৃত রেখেছে। ২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলা ভাই প্রকাশ্যে হত্যা করে ২২ জন সাধারণ মানুষকে। কপিকলে উল্টো করে বেঁধে মানুষকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হতো, মাইকে সেই আর্তনাদ শোনানো হতো গ্রামবাসীকে। কী ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে বাংলাদেশকে, অথচ বিএনপি-জামায়াত সরকার নির্লজ্জের মতো সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছে যে- বাংলা ভাই বলে কিছু নেই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি!

জঙ্গিদের সহযোগিতা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাধ্য করতো বিএনপি সরকার:

২০০৫ সালের ২১ মার্চ জনকণ্ঠের খবর থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের শেষের দিকে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জঙ্গি ও ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের নাম প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বোমা বিস্ফোরণ ও জঙ্গিবাদী মামলাগুলোর অপমৃত্যু ঘটানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের এভাবে মুক্ত করে দেওয়ার ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থা ক্ষুব্ধ হয়। এমনকি এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের গ্রেফতারে সম্পৃক্ত গোয়েন্দাদের অনেকের চাকরি নিয়েও টানাটানি পড়ে তখন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, চাঞ্চল্যকর এসব মামলা থেকে যারা রেহাই পেয়েছে তারা অধিকাংশই জঙ্গি সংগঠনের সদস্য।

২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির সংবাদে দেখা যায়, মহান একুশে পালনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে তাণ্ডব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা। খালেদা জিয়ার সরকারের নির্দেশে কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার অজুহাতে সাধারণ মানুষদের শহিদ মিনারে যেতে দেয়নি। নীলফামারীতে শহিদ মিনার গুড়িয়ে দিয়েছে জিয়া পরিষদের নেতাকর্মীরা। নোয়াখালীতে মাইক কেড়ে নিয়ে উগ্রবাদী বক্তব্য দেয় সন্ত্রাসীরা। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় প্রশাসনের প্রভাতফেরিতেও বাধা দেয় বিএনপির ক্যাডাররা। খুলনায় পুলিশি বাধার মুখে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।

২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির খবরে জানা যায়, ফরিদপুর জেলার নগরকান্দায় ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে এলাকাবাসীর তৈরি করা অস্থায়ী শহিদ মিনারটি বিএনপি নেতাদের সহায়তায় ভেঙে ফেলে জামায়াত নেতারা। ফলে ২০০৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি এলাকাবাসী।

২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির খবরে আরো জানা যায়, জামায়াতকে খুশি করার জন্য নাটোরে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহিদদের স্মরণে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দেয়নি বিএনপি। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুল হক পটলের এলাকা নাটোরের লালপুরে বিএনপি নিজেও অমর একুশে পালন করেনি, এমনকি বিএনপির অফিসেও ওড়েনি অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা।

২০০৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির খবরে জানা যায়, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একুশের সঙ্গীতের পরিবর্তে সমবেতভাবে শিবিরের দলীয় গান গেয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করেছে ছাত্রশিবির। অমর একুশে পালনের নামে তারা জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং রাজাকার প্রধান গোলাম আযমকে একুশে পদক দেওয়ার দাবিতে ক্যাম্পাসে শোভাযাত্রা ও হৈহুল্লোড় করে গণউৎপাত সৃষ্টি করে। লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বহিরাগতদের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে শো-ডাউন দেয় ছাত্রশিবির, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকেরা ভয়ে আতঙ্কিত হয় এবং মহান একুশের ভাবগাম্ভীর্য ভূলুণ্ঠিত হয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত