জামায়াত-শিবির-স্বাধীনতাবিরোধীদের দিয়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলো

1058

Published on মে 31, 2023
  • Details Image

জঙ্গিবাদী নাশকতাকারী সংগঠন বলতে জেএমবি, হরকত উল জিহাদ, বাংলা ভাই প্রমুখের ভয়াবহতার নামই সবার আগে মনে হয় আমাদের। আসুন দেখে নেই কারা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছে এসব জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলো। জঙ্গিরা ধরা পড়ার পর তাদের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা তৎপরতা, গণমাধ্যমের স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধান, এমনকি বিএনপি-জামায়াতের সূত্রের এসব তথ্যকে সত্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। 

২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিলের জনকণ্ঠের সংবাদে উঠে আসে জেএমবি নেতাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড। দেখা যায়, স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকার পরিবারের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছিল এই জেএমবি। জেএমবিতে যোগদানের আগে তারা শিবির ও জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। জেএমবির শুরা সদস্যের সাত জনের সবারই ধর্মীয় রাজনীতির হাতেখড়ি শিবিরের মাধ্যমে। জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমানের বাবা ছিল ১৯৭১-এ জামালপুরের আল বদর কমান্ডার, তার নাম আবুল ফজল। শায়খ আবদুর রহমান নিজেও শিবিরের অগ্রগামী সংগঠন ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিল। পারিবারিকবাবে তার সঙ্গে জামায়াতের সব শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

সাবেক ছাত্রসংঘ নেতা শায়খ আবদুর রহমানের ছোটভাই আতাউর রহমান সানি মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় ছিল শিবিরের সাথী, পরে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শিবিরের অন্যতম প্রধান সাংগঠনিক নেতা হয়। ২০০০ সালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের পর কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। পরবর্তীতে জেএমবির সামরিক শাখার দায়িত্ব নেয় এবং সারাদেশের শিবিরের সঙ্গে জেএমবির নেটওয়ার্কিংয়ের কাজটি করতো সে।

জেএমবির আরেক অপারেশনাল কমান্ডার সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই আযিযুল হক কলেজে শিবিরের রগকাটা বাহিনীর নেতৃত্ব দিতো। পরে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর পরামর্শে জেএমবিতে যোগ দেয়। বগুড়ার রাজাকার পরিবারের সন্তান হওয়ায় তারেক রহমানের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল বাংলা ভাইয়ের। ফলে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির সার্বিক যোগাযোর কাজটাও করতো সে। একারণে বাংলা ভাইয়ের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ নিয়ে গণমাধ্যমে নিয়মিত ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও নিজামী তা অস্বীকার করে বলেছিল- বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি! এমনকি ময়মনসিংহ অঞ্চলে গ্রামবাসীরা বাংলা ভাইকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেও, তারেক রহমানের হুকুমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।  

জেএমবির শুরা সদস্য নুরুল হুদা আবেদও ছিল একজন প্রভাবশালী শিবির নেতা। পরবর্তীতে শায়খের সঙ্গে জেএমবি গঠন করে সে।

২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের পত্রিকায় শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকারী, রমনা বটমূল, উদীচী ও সারাদেশে বোমা হামলার অন্যতম হোতা মুফতি হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায়। তার ভাই মতিয়ার রহমান মতি কোটালিপাড়া থানা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। বিএনপি নেতা এই ভাইয়ের মাধ্যমে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার নির্দেশনা গ্রহণ এবং কোনো অপারেশন শেষ করার পর তাদের কাছে রিপোর্ট পেশ করতো মুফতি হান্নান।

তাদের সবার লক্ষ্য ছিল, জামায়াত-বিএনপির সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো। আর মৌলবাদী সন্ত্রাসীর আড়ালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যা করা। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্টাইলে দেশের প্রগতিশীল শিক্ষক, বৃদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বিচারক, পেশাজীবী, সংস্কৃতি কর্মীদের হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য থেকে দেশকে পাকিস্তানিকরণের দিকে নিয়ে যাওয়া।

জেএমবির মজলিসে শুরার হাফেজ মাহমুদ দেশব্যাপী বোমা হামলার ঘটনায় আটকের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতকে জেতাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল জেএমবির ক্যাডাররা। বিএনপির পক্ষ থেকেও ক্যাডারভিত্তিক সাহায্য চাওয়া হয়েছিল তাদের কাছে।  

২০০৫ সালের ২৩ আগস্টের পত্রিকায় গোয়েন্দাদের বরাতে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের সময়টাতে কমপক্ষে ১৪টি ভিন্নধারার উগ্রবাদী সংগঠনের ছদ্মবেশে দেশে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে জামায়াত। জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় ও শিবিরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে উগ্রবাদি জঙ্গিরা। এরপর জামায়াত-শিবিরের শক্তিতে ভর করেই সশস্ত্র তৎপরতা চালায় তারা। আধুনিক সমরাস্ত্রসহ একটি বড় জঙ্গিদলকে গ্রেফতারের পরেও সরকারে থাকা জামায়াত নেতাদের চাপে ওই জঙ্গিদের ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে চার্জশিট না দিয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। 

বাংলা ভাই জেএমবির কার্যক্রম শুরু করে জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহীতে জামায়াত নেতার বাড়িতে বসেই শুরু হয়। ২০০৪ সালের ৩০মে রাজশাহীর বাগমারার আলোকনগর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার রমজান কায়ার বাড়িতে প্রথম ঘাঁটি গড়ে বাংলা ভাই। এরপর তার ছাত্র জীবনের শিবিরের বন্ধু রফিকের বাড়িতেও আরেকটি বৈঠকখানা করে সে। ২০০৫ সালের জুন মাসে গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রফিক জানায়, জামায়াত-শিবিরের ওপর ভর করেই মাঠপর্যায়ে কাজ করেছে তারা। রফিকের মাও জানান, জামায়াত-শিবিরকে সঙ্গে নিয়েই সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলতো বাংলা ভাই। রাজশাহী মহানগরের এক জামায়াত নেতা পরের নির্বাচনে এমপি ভোট করার থাকায়, তাকে জেতাতে বাগমারার একটি ক্লিনিকে আস্তানা গড়ে বাংলা ভাই। পরবর্তীতে ভবানীগঞ্জের সেই ক্লিনিকের মালিক ড. বারী তার সঙ্গে জামায়াতের সম্পৃক্ততা আছে স্বীকার করে।

এমনকি দেশজুড়ে জঙ্গি কার্যক্রমের অন্যতম হোতা, বাংলা ভাইয়ের সহকারী ও বোমা বিশেষজ্ঞ আসাদুল্লাহ গালিব রাজশাহীতে ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলন করার সময় তার সঙ্গে উপস্থিত থাকতের খুলনার জামায়াত দলীয় এমপি আবদুল খালেক ও রাজশাহী সিটির মেয়র মিজানুর রহমান মিনু। এসময় বিএনপি-জামায়াতের এসব শীর্ষ নেতারা গালিব ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে জঙ্গি তৎপরতার কোন সম্পর্ক নাই বলে সার্টিফিকেট প্রদান করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে কতো অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, তা স্পষ্ট হয় তাদের সরকারি দায়িত্বে থাকা শীর্ষ নেতাদের এরকম উদ্ধত কর্মকাণ্ডে।

২০০৫ সালের ২৩ জুলাইয়ের খবরে পুলিশের বরাতে জানা যায়, রাজশাহী থেকে গ্রেফতার বাংলা ভাইয়ের অনুগত ১১ জেএমবি জঙ্গিকে গ্রেফতারের পর তারা তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিএনপি সরকারের প্রধান জোটসঙ্গী জামায়াতের নাম বলেছে। এছাড়াও বাংলা ভাইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান ও সৌদি আরব থেকে তাদের অর্থের সংস্থান হয় বলেও জানায় তারা। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলের সদস্যরা এসব তথ্য জানার পর হতবাক হয়ে যায়।

২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিস্ট ব্রাঞ্চের তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিদের তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের অদৃশ্য পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাইসহ এসব জঙ্গিরা নাশকতা পরিচালনা করে তদন্ত প্রতিবেদনে জানায় তারা। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চার সদস্যের টিম বাংলাদেশে সরেজমিনে তদন্তের পর এই প্রতিবেদন দেয়। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরীর ওপর সিলেটের মাজারে বোমা হামলার ঘটনা তদন্ত করতে এসে তারা এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে।

২০০৫ সালের ২ অক্টোবর জনকণ্ঠের  সংবাদে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের শাসনামলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর উত্তরাঞ্চলের জঙ্গিবাদী নেটওয়ার্ক পরিচালনা হতো বগুড়া থেকে। বগুড়ায় তারেক রহমানের নিয়মিত যাতায়াত থাকায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম তারেককে প্রটোকল দেওয়ার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ায় এবং সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা-নির্যাতন করার জন্য উগ্রবাদি জঙ্গীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে বগুড়া। গাবতলী, কাহালু, নন্দীগ্রাম, সারিয়াকান্দি, শেরপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চল ও প্রত্যন্ত গ্রামে জেএমবির জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এছাড়াও বগুড়ার উপকণ্ঠে বিভিন্ন মেস ও বাড়িতে ছদ্মবেশে সারাদেশ থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ক্যাডাররা এসে আশ্রয় নেয়। পুলিশ জানায়, ক্লিন শেভ ও বেশভূষা পরিবর্তন করে জঙ্গিরা অবস্থান করায় তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

২০০৫ সালের ৪ অক্টোবরের খবর থেকে জানা যায়, বগুড়ায় বাংলা ভাইয়ের বাড়িকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয়। বিশেষ করে গাবতলীর কয়েকটি গ্রাম, একটি হাটের পাথার ও প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে এসব জঙ্গিদের ট্রেনিং, বোমা বানানোর স্কোয়াড, মহিলা ক্যাডার তৈরির মূল কার্যক্রম চালানো হতো। গাবতলীর গোলাবাড়ি থেকে গ্রেফতার জঙ্গি ক্যাডার রাজ্জাক ওরফে হাসান এসব তথ্য জানায়। রাজ্জাক জানায়, ১৭ আগস্ট বগুড়ার বোমা হামলার পর সেসহ আরো কয়েকজন জঙ্গি রিকশা চালকের ছদ্মবেশে অংশ নিয়েছিল।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত