2011
Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2023১৯৪৭ সালের আগস্টে অখণ্ড ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টির সময় পূর্ব-বাংলা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারণে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক বৈষম্য থেকে রক্ষা পেয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য পাকিস্তানে যোগদান যে ভয়াবহ ভুল ছিল, তা অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারে বাঙালি জাতি। দেশভাগের পরপরই আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পাঁয়তারা শুরু করে পাকিস্তানি জান্তারা।
কিন্তু পাকিস্তানিদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরুতেই প্রতিবাদ করে বাংলার ছাত্র সমাজ। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক সম্পন্ন করা এবং ওই কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৎকালীন প্রভাবশালী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান শুরু থেকেই পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তির পর ক্যাম্পাস অবস্থান করে বাংলা ভাষার আন্দোলনকে সংগঠিত করতে থাকেন তিনি। একারণে পাকিস্তানিদের রোষানলে পড়ে বারবার জেলে যেতে হয় তাকে।
দেশভাগের আগে অখণ্ড বাংলার (পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা) শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী এবং শিষ্য হওয়ায় আস্থাভাজন ও গ্রহণযোগ্য ছাত্রনেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব ও পরিচয় ছিল সর্বমহলে। একারণে তিনি শুরু থেকে ভাষা আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকায়, সারাদেশের মানুষ নিজেদের মায়ের ভাষার অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
দেশভাগের পর শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন এবং ভাষা আন্দোলনের সূচনা-পর্ব:
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত সৃষ্টির পর কলকাতা থেকে ঢাকায় ফেরেন সুপরিচিত ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুব সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা হিসেবে সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন শেখ মুজিব।
ইতোমধ্যে শুধু উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়। এরপর দ্রুত গঠিত প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশ নেন এবং বিভিন্ন মিটিং মিছিলে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন শেখ মুজিব। ৫ ডিসেম্বর পূর্ব-বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলে নিয়ে সেখানে যান তিনি।
এর কয়েকদিন পরেই সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেন। এটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘রাষ্ট্র্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন সেই ১৪ জনের অন্যতম স্বাক্ষরদাতা।
ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে আপসহীন শেখ মুজিবের মুসলিম লীগ ত্যাগ এবং ছাত্রলীগ গঠন:
বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে কোনো ভূমিকা নেয়নি তৎকালীন মুসলিম লীগ। বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা উল্টো ধর্মব্যবসার মনোনিবেশ করে পাকিস্তানি শোষকদের মদত দিতে থাকে। ফলে ১৯৪৮ সালেই মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এরপর, ৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮; প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম।
১৯৪৮: যেভাবে ভাষা আন্দোলনের প্রধান সংগঠক হয়ে ওঠেন তেজস্বী ছাত্রনেতা শেখ মুজিব:
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮: পূর্ব-বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮: বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে ধর্মঘট চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিসের প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে, এই মিছিলের ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন।
২ মার্চ, ১৯৪৮: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যৌথ সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শেখ মুজিব।
১১ মার্চ, ১৯৪৮: রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ব-বাংলায় সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে, তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ভূখণ্ডে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতাল সফল করতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠে নামেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষার দাবিতে প্রথম ধর্মঘটে সক্রিয় নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সচিবালয়ের এক নম্বর গেটের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট মূলত এই দিনটিই।
বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী-প্রতিবাদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করলেও, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চাপে ১৫ মার্চ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
১৬ মার্চ, ১৯৪৮: ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ব-বাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের করে শিক্ষার্থীরা। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য-কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
১৭ মার্চ, ১৯৪৮: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রলীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় অংশ নেন শেখ মুজিব। তার নির্দেশে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ছাত্রলীগ অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে থাকে।
২১ মার্চ, ১৯৪৮: ঢাকা এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে) বক্তব্য দেওয়ার সময় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সামনের সারিতে থেকে সশরীরে এই বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ যারা করেছিলেন, মুজিব ছিলেন তাদেরই একজন। এরপর ২৪ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো একই ঘোষণা দিলে তীব্র প্রতিবাদ জানায় শিক্ষার্থীরা।
১৯৪৯: দেশজুড়ে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ায় ছাত্রত্ব বাতিল করে বারবার বন্দি করা হয় মুজিবকে
১৯৪৮ সালজুড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলনের মূল সংগঠক হয়ে ওঠায়, শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনকে সমর্থন করার অজুহাতে, পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলন বেগবান করার কারণে- ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি, ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন, ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দফায় দফায় তাকে দফায় দফায় জেলে যেতে হয়। ।
২৩ জুন, ১৯৪৯: পাকিস্তান মুসলিম লীগের দমনপীড়নের প্রতিবাদে বিকল্প রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দানের কারণে অপরিহার্য যুবনেতা হিসেবে, জেলে থাকা অবস্থাতেই, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পদ পান শেখ মুজিবুর রহমান।
২৯ জুলাই, ১৯৪৯: ভাষা আন্দোলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ায় দুই মাসের বেশি সময় জেল খাটার পর মুক্তি পেয়েই ভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব-বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনে শরিক হন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এদিন নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সমাবেশে ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দফতর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানান তিনি।
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯: ছাত্রলীগ থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, 'আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র নাই। তাই ছাত্র প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকার আর কোনো অধিকার আমার নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বাংলা ভাষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, মানুষ তা ভুলবে না। আরবি হরফে বাংলা লেখার চক্রান্ত চলছে। আপনারা তা রুখে দাঁড়ান। আপনারা আমাকে (ছাত্রলীগের) প্রতিষ্ঠাতার সম্মান দিয়েছেন। আপনারা যখনই আমাকে ডাকবেন, তখনই পাবেন। তবে এখন থেকে আমি বেশি সময় দেব আওয়ামী মুসলিম লীগে। বিদায় বেলায় আপনাদের বলি- ছাত্রলীগ নেতাদের ভালো ছাত্র হতে হবে। কেবল পাঠ্যবই পড়লেই চলবে না। আপনারা পাঠাগার গড়ে তুলবেন। স্টাডি সার্কেল করুন।'
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯: ঢাকার আরমানিটোলায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, 'ছাত্ররা জেগে উঠেছে। ছাত্রলীগ সম্মেলন সফল করেছে। সম্মেলনে দাবি তোলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং চালুর জন্য। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষার জন্য পাঞ্জাবি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। এখানের নদী-খাল-বিলে তারা কী করবে? আমাদের মাটি আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।'
ভাষা আন্দোলনকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি থেকে বের করে গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করেন শেখ মুজিব:
১৯৪৮ এবং ১৯৪৯ সালজুড়ে ভাষা আন্দোলনকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি থেকে বের করে জনসাধারণের দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে যান যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এসবের মধ্যেই সারাদেশের সচেতন মানুষদের সঙ্গে নিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জনসমাবেশ এবং মিছিল বের করেন তিনি। এই মিছিলের স্লোগানে এবং ভাষণে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পাশাপাশি, বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিও ছড়িয়ে দেন দূরদর্শী নেতা শেখ মুজিব।
১ জানুয়ারি, ১৯৫০: ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে এলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক নিয়ে বিশাল ভুখা মিছিল বের করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর প্রায় দুই মাস ধরে ভাষা আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে তীব্র গণসংযোগ শুরু করেন। ফলে ভাষা আন্দোলন দমিয়ে দেওয়ার জন্য ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সরকার। এরপর একটানা ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জেলে বন্দি রাখে পাকিস্তান সরকার।
জেলে থাকা অবস্থাতেও ছাত্রনেতারা বিভিন্নভাবে ভাষা আন্দোলনের জন্য নিয়মিত নির্দেশনা নিতেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে। ফলে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের জেলে স্থানান্তর করা হয় তাকে। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর যাওয়ার সময়ও ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সফল করার নির্দেশনা দেন শেখ মুজিব। এমনকি এরপর নিজেও জেলের মধ্যে আমরণ অনশন শুরু করেন। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ অবস্থায় তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২: রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরো অনেকে। জেল থেকে বঙ্গবন্ধু এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন এবং একটানা ৩ দিন তা অব্যাহত রাখেন।
জেলে থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লেখেন, 'দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে। তুরস্কের লোকেরা তুর্কি বলে। ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে। মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে। চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই।'
বাংলা ভাষার অধিকার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় পাকিস্তানের গণপরিষদে শেখ মুজিব:
১৯৪৮ সাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করেন, তার ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে তা আমজনতার দাবিতে পরিণত হয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালের ৭ মে গণপরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করে। এরপর, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতির পেছনেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৯৫৫ সালের ২১ জুন পাকিস্তান গণপরিষদ তথা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য এবং ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এসময় জনগণের মতামত ছাড়াই পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক 'পূর্ব-বাংলা'র নাম 'পূর্ব-পাকিস্তান' করার প্রতিবাদ জানান তিনি। এর আগে, ১৭ জুন পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন আইন পরিষদের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান।
একই বছর, ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'পূর্ববাংলা নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে।…আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তা হলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা-সেজন্য গণভোট নিতে হবে।'
সর্বশ্রেণির মানুষকে নিয়ে বাঙালি জাতির অধিকার আন্দোলন বেগবান করার জন্য, একই বছর ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের মূলনীতি হিসেবে নেওয়া হয়। ফলে ২১ অক্টোবর সম্মেলনে, আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' নামকরণ করা হয় বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে।
১৭ জানুয়ারি, ১৯৫৬: আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণের দাবি জানান।
৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬: আইন পরিষদের অধিবেশনে খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ''পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যে সব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।''
১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬: আইন সভার অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাষা আন্দোলনকে ক্রমেই স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত করেন বঙ্গবন্ধু:
বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক নির্যাতন ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র বিস্ফোরণের প্রকাশ ছিল ১৯৫২ সালের চূড়ান্ত ভাষা আন্দোলন। অধিকার আন্দোলনের সেই পথ ধরেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির সর্বাত্মক সমর্থন লাভ করে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ১৯৭১ সালের ২০-২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে একটি মশাল মিছিল বের করা হয়। শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে এক বিরাট ছাত্র-জনসমাবেশে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু।
সেই ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে আরো রক্তদানের জন্যে ঘরে ঘরে প্রস্তুত থাকুন। ... আমি আজ এই শহীদ বেদি থেকে বাংলার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি- প্রস্তুত হও, দরকার হয় রক্ত দিব। নির্বাচনে আমরা বিপুল সাফল্য অর্জনের পরও বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজো চলছে। ...কিন্তু শোষকদের জানা উচিত, ৫২ সালে বাঙালির যে রূপ ছিল, তার সাথে ৭১ সালের বাঙালির অনেক পার্থক্য রয়েছে। ভ্রাতৃত্বের অর্থ দাসত্ব নয়। সম্প্রীতির, সংহতির নামে বাংলাকে আর কলোনি বা বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যারা বাঙালির স্বাধিকারের দাবি বানচালের ষড়যন্ত্র করছে, বাঙালিদের ভিখারি বানিয়ে, ক্রীতদাস করে রাখতে চাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য যে কোনো মূল্যে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে।'
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জেতার পর, ১৯৭১ সালের শহীদ দিবসের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে মুক্তির জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে তো একদিন মরতেই হয়। তাই আজ আমি আপনাদের এবং সারা বাংলার মানুষকে ডেকে বলছি- চরম ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হোন। বাঙালি যেন আর অপমানিত-লাঞ্ছিত না হয়। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। শহীদ স্মৃতি অমর হোক।'
এমনকি স্বাধীনতার পরও বারবার বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এমনকি একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ অফিসের কাজে বাংলাভাষা প্রচলনের জন্য সরকারি নির্দেশ পর্যন্ত জারি করেন।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জারিকৃত সেই আদেশে বলা হয়, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালোবাসা আছে একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।”