1290
Published on জানুয়ারি 20, 2023হীরেন পন্ডিতঃ
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২,৮২৪ ডলার। মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতু উদ্বোধন- দুটিই উন্নয়নের মাইলফলক। সফলভাবে কারোনা মহামারি মোকাবিলা, শিক্ষা, যোগাযোগ অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নারী শিক্ষা, চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা শতভাগ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক কর্মসূচির আওতায় পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, অসহায়, বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সহায়তা, অটিজম, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়নসহ ও বিভিন্ন সেক্টরের সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও আইসিটি খাতে বিপ্লব সাধন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় অসামান্য সাফল্যে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে ও বিশ্বে পঞ্চম স্থানে আসীন করা, দেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের কাতারে শামিল করাসহ বাংলাদেশের অসংখ্য কালোত্তীর্ণ অর্জনের কারিগর সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। যদিও করোনা-উত্তর বৈশি^ক সমস্যা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট চাপে সারাবিশ^ বর্তমানে আক্রান্ত। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
৮ জানুয়ারি, ২০০৯-এ দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে শেখ হাসিনা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এমডিজি এবং প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন এবং সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এগুলো হলোÑ দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সমাজ, আবাসন সমস্যার সমাধান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং ডিজিটালাইজেশনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ সুবিধা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার চারটি স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলোÑ স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। সরকার বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে জনশক্তিই হবে স্মার্ট। সবাই অনলাইনে সব করতে শিখবে। অর্থনীতি হবে ই-অর্থনীতি, যেখানে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করা হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান’ সবই হবে ই-গভর্নেন্সের মাধ্যমে। ই-শিক্ষা এবং ই-স্বাস্থ্যসহ সবটাতে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে।
আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে এটি করতে সক্ষম হব এবং তা মাথায় রেখে কাজ চলছে। তরুণ সমাজ যত বেশি এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলো ব্যবহার করতে শিখবে, তত দ্রুত তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন বিষয়ে তরুণদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করা হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর বাংলাদেশের মানুষের আস্থা রয়েছে। শেখ হাসিনা দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করেছেন। বর্তমান সরকারই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারবে। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। আজ বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। এখন যে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছেন তাও শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪টি মাইলফলক দিয়েছেন। প্রথমটি ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প, যা অনেকাংশে অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয়টি ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন। তৃতীয়টি ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি হচ্ছে ২০৪১ সালে। ২১০০-এর জন্য ডেল্টা প্ল্যান।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হবে, তখন মাথাপিছু আয় ১২,৫০০ ডলারের বেশি হবে। বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য থাকবে সীমিত। আগামী দুই দশকে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ, ব্যবসায়িক অনুশীলন এবং কর্মক্ষমতা অর্জনের পদ্ধতিতে দেখা যাবে পরিবর্তন। এর ধারাবাহিক পরিবর্তনের সুফল সমাজের সকল স্তরে সুষম বণ্টনের দৃষ্টিভঙ্গিতে জোর দেওয়া হয়েছে।
সুশাসনের চারটি স্তম্ভ, গণতন্ত্র, বিকেন্দ্রীকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি রূপকল্প ২০৪১ অর্জনের প্রধান এজেন্ডা হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে ডিজিটাল প্রযুক্তিভিত্তিক রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলা হবে। ২০৪১ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হবে জিডিপির ৪৮.৬ শতাংশ, যা বর্তমানে ৩২.৬ শতাংশ। রপ্তানি আয় ২০২১ সালের কাক্সিক্ষত ৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৪১ সালে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা আবশ্যক।
একটি আধুনিক শহুরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় মেট্রোরেল সংযোগ, হাইওয়ে করিডরের বর্তমান গড় গতি ২৫-৩০ কিমি/ঘণ্টা থেকে ৬০-১০০ কিমি/ঘণ্টায় উন্নীত করা, সমস্ত রেললাইনকে ব্রডগেজ সিস্টেমে উন্নীত করা এবং আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন, জাহাজের উন্নয়ন, ড্রেজিং, নদী ব্যবস্থাপনা ও বাঁধ নির্মাণ, বিমানবন্দরে অতিরিক্ত রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে স্থাপন এবং মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে টোল আদায়ের মাধ্যমে নাব্য উন্নত করার জন্য আগামী দুই দশকের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নগরায়ণ এবং উন্নয়ন হবে অত্যন্ত গভীর এবং ইতিবাচকভাবে সম্পর্কিত। উন্নত দেশগুলোর মতো ২০৪১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ শহরে বসবাস করবে। এর জন্য প্রস্তুতিগুলো উচ্চ আয়ের অর্থনীতিতে শহুরে পরিবর্তনশীলতার পরিমাপ শিরোনামে বর্ণিত হয়েছে। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচির আওতায় শহরের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রামাঞ্চলে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণের পরিবর্তে অনেক নগরকেন্দ্রের সুষম উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। শহরের বাতাসের গুণমান, গণপরিবহন, যানবাহন, পয়ঃনিষ্কাশন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে।
টেকসই পরিবেশগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং একটি জলবায়ু সহিষ্ণু টেকসই জাতি গঠন এবং একটি গতিশীল প্রাণবন্ত বদ্বীপে সবুজ অর্থনীতির সম্ভাবনা উন্মোচন করা, জলবায়ুর অভিঘাত অভিযোজন প্রচেষ্টার ওপর ভিত্তি ধরে কাজ করা, জোয়ারের ওঠানামা, লবণাক্ততা, বন্যা, নদীভাঙন এবং জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের নিয়মিত বিষয়, যা উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর অধীনে, বর্তমান পরিকল্পনা সুনীল অর্থনৈতিক সম্পদ (মৎস্য, সামুদ্রিক শৈবাল, খনিজ সম্পদ) আহরণের ওপর সরকার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।
২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জনে সরকারের উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য এবং তা বাস্তবায়নের জন্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। এই পথ নকশার পথ অনুসরণ করে ২০৪১ সালে অর্জিত হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা বর্তমানে একটি অবিশ্বাস্য পদ্ধতিগত মৌলিক পরিবর্তন (প্যারাডাইম শিফট) প্রত্যক্ষ করছি। প্রচলিত ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তরের পথ ধরে এই পরিবর্তন ঘটছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে ডিজিটাল রূপান্তর দ্রুত গতিতে ঘটছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে, আমরা দেখতে পাচ্ছি ৩ডি প্রিন্টার থেকে মুদ্রিত হচ্ছে অনেক কিছু এবং সামনে আনা হচ্ছে। যদিও সিস্টেমের এই বিষয়টি মৌলিক পরিবর্তনের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্প বাস্তবায়নে মহাকাশ অর্থনীতি নামে আরেকটি খাত দেখা যেতে পারে। এমন উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ শুধু একটি রূপকল্প নয়; পূর্ব ঘোষিত ‘ভিশন ২০৪১’ ছাড়াও একটি মহাকাশ অর্থনীতি গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। মহাকাশ অর্থনীতি গড়ে তোলার পরিকল্পনাকে দুটি কারণে সাধুবাদ জানাতে হয়। প্রথমত, বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, মহাকাশ গবেষণা এবং অর্থনীতি ও তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণের জন্য বাংলাদেশকে আরও বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্যাটেলাইটে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত লাভজনক।
স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্পের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক- একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি, একটি উদ্ভাবনী জাতি এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গঠন। এর সুচিন্তিত বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি, রি-স্কিলিং এবং আপ-স্কিলিংয়ের মাধ্যমে এই নতুন পরিবর্তনকে গ্রহণ বা অভিযোজন করা, জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ; স্থানীয় পর্যায়ে আন্তর্জাতিক স্টার্টআপ পরামর্শদাতা এবং ব্যবসায়িক প্রশিক্ষকদের পরামর্শ গ্রহণ করার মাধ্যমে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ স্টার্টআপ এডুকেটরদের জন্য একটি বিকল্প স্কুল এবং জ্ঞান উদ্ভাবন এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : গবেষক
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ