জগন্নাথ হলেই ছিলাম

678

Published on ডিসেম্বর 6, 2022
  • Details Image

কালীরঞ্জন শীলঃ

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কোটি মানুষের স্বপ্নে, ত্যাগে, বীরত্বে রচিত হয়েছে এর ইতিহাস। কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে মুক্তিযুদ্ধের কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আজকের জানাবো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিবরণ।

আমি থাকতাম জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ির ২৩৫ নম্বর কক্ষে। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অল্পক্ষণের মধ্যে। মাথার কাছে বিকট এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হচ্ছিল, হলের পুরোনো দালান বুঝি এক্ষুনি ভেঙে পড়বে। এমন গোলাগুলির শব্দ জীবনে শুনিনি। 

বারান্দার দেয়ালের আড়ালে নুয়ে নুয়ে দক্ষিণ দিকে গেলাম এবং সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলাম। আমার পায়ের শব্দ পেয়ে খুব আস্তে কয়েকজন ‘কে’ বলে ডেকে উঠল। আমি সাড়া দেওয়ায় ওরা আমাকে ছাদে ওঠার জন্য বলল। আত্মরক্ষার জন্য কয়েকজন ছাত্র আগেই ওখানে জড়ো হয়ে ছিল। কিন্তু ওদের কাছে আমি থাকলাম না। স্বার্থপরের মতো একা থাকতে মনস্থ করলাম। তাই ওখান থেকে নুয়ে নুয়ে দালানের উত্তর মাথায় যেতে শুরু করলাম।

উত্তর দিকে তাকিয়ে দেখি সব বিল্ডিং, মাঠ, রাস্তা ও পশ্চিম দিকের সবটাই অন্ধকার। দেখা যাচ্ছিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা টর্চের সাহায্যে রুমে রুমে ছেলেদের খুঁজে বের করে এনে হলের শহীদ মিনারের কাছে গুলি করে মারছে। মাঝেমধ্যে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী দালানের ওপর ভারী কামানের গোলাবর্ষণ করছিল। কোনো কোনো ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল। একসময় দেখলাম, অ্যাসেম্বলি ভবনের সামনের টিনের ঘরগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। উত্তর বাড়ির কয়েকটি রুমেও আগুন জ্বলতে দেখলাম। নিচে থেকেই গুলি করে কীভাবে যেন দোতলা–তিনতলার জানালায় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে কেমন যেন দু–একটি গুলির শব্দ হচ্ছিল আর ওপর থেকে নিচে বেলুনের মতো এক–একটি আগুনের গোল্লা আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছিল। ওই আলোতেই দেখলাম, উত্তর বাড়ির মাঠে শত শত মিলিটারি মেশিনগান ও ভারী কামান দিয়ে হলের দিকে নির্বিচার গোলাবর্ষণ করছে।

হঠাৎ একসময় দেখা গেল, সলিমুল্লাহ হলের দিক থেকে ৪০–৫০ জন পাকিস্তানি মিলিটারি দক্ষিণ বাড়ির দিকে এল এবং দরজা ভেঙে খাবার ঘরে ঢুকল। খাবার ঘরের আলো জ্বালল এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ল কিছুক্ষণ। কয়েকজন শেষ চিৎকার করে মৃত্যুবরণ করল বোঝা গেল। আমি ল্যাট্রিনের জানালা গলিয়ে তিনতলার কার্নিশে নেমে শুয়ে পড়লাম। পিঠ দিয়ে টানতে টানতে কার্নিশের কোনার দিকে গেলাম এবং শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় শুয়ে রইলাম। একতলা, দোতলা করে এভাবে ওরা তিনতলায় উঠল বুঝলাম। একসময় আমার কাছেই কয়েকটি গুলির শব্দ হলো। আমার মাথা-সোজা দেয়ালের ঠিক বিপরীত দিকে একটা লোক গোঙাচ্ছে শুনতে পেলাম।

একসময় দেখা গেল সলিমুল্লাহ হলের দিকে আগুন। মাঝেমধ্যে উত্তর ও পশ্চিম দিকের আকাশ লাল হয়ে উঠছিল। বুঝতে পারছিলাম, কোথাও আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। গোলাগুলির মধ্যে কোনো কোনো দিক থেকে একসঙ্গে অনেক মানুষের আর্তধ্বনি শুনেছি বহুবার। সারা রাতই চলছিল পাকিস্তানি বাহিনীর এই ধ্বংসলীলা।

একসময় কোনো এক দিক থেকে আজানের শব্দ শুনতে পেলাম। ভোরের দিকে মাইকে কারফিউ জারির ঘোষণা শুনলাম। একটু ফরসা হতেই দেখা গেল, রাতের অন্ধকারে এখানে-ওখানে যারা পালিয়ে ছিল, তাদের ধরে এনে গুলি করে মারছে। আমাকে যাতে দেখতে না পায়, সেভাবে মাথা নিচু করে ল্যাট্রিনের মধ্যে থাকলাম আর মাঝেমধ্যে একটু উঁকিঝুঁকি মারছিলাম।

এভাবে বেলা হলো। একসময় আমার কাছাকাছি বারান্দায় অনেকের কথা শুনতে পেলাম। ছাত্ররা কথা বলছে এটা নিশ্চিত হয়ে ল্যাট্রিনের দরজা খুলে বেরোলাম। বেরিয়েই দেখি, সিঁড়ির মাথায় মেশিনগান তাক করে পাকিস্তানি মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে আর কয়েকজন ছাত্র একটি লাশ ধরাধরি করে নামানোর চেষ্টা করছে। রাতে আমার মাথার কাছে দেয়ালের ওপাশে যাঁকে গুলি করে মেরেছিল, এটা তাঁরই লাশ। তিনি আর কেউ নন, আমাদের হলের পুরোনো দারোয়ান সবার প্রিয় প্রিয়নাথদা। আমিও আর ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম না। ছাত্ররা আমাকেও ইঙ্গিত করল লাশ ধরতে। লাশটি তিনতলা থেকে দোতলা, সেখান থেকে একতলা এবং একতলার সর্বদক্ষিণের ভাঙা গেট দিয়ে ব্যাংকের উত্তর পাশে নিয়ে রাখলাম। বিভিন্ন রুম থেকে আরও লাশ জড়ো করা হলো সেখানে।

আমাদের ওখান থেকে লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। গেটের দক্ষিণ পাশের গা ঘেঁষে একটি বিরাট গাছ ছিল। লাশগুলো গাছের নিচে জড়ো করতে লাগলাম।

ওখানে আমাদের কয়েক ভাগে ভাগ করা হলো। একেক ভাগ একেক দিকে নিয়ে গেল। আমাদের নিয়ে গেল ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা যে বিল্ডিংয়ে থাকতেন, সেই বাসার দিকে। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখি, অনেক লাশ পড়ে আছে। বোঝা গেল, রাতে সিঁড়ির কাছে এনে গুলি করে মেরে রেখেছে। লাশগুলোর পাশ দিয়ে দোতলা–তিনতলা করে আমাদের নিয়ে গেল চারতলায়। ওরা প্রতিটি রুম খুঁজছিল কোনো জীবিত প্রাণী আছে কি না।

আমাদের আবার লাশ নিতে বলল। রাস্তা দিয়ে সোজা উত্তর দিকে যেতে বলল। কতগুলো লাশ এভাবে বহন করেছি, ঠিক মনে নেই। তবে শেষ যে লাশটি টেনেছিলাম, তা ছিল দারোয়ান সুনীলের। তাঁর শরীর তখনো গরম ছিল। সুনীলের লাশ নিয়ে রাস্তা থেকে মাঠের মাঝামাঝি যেতেই হঠাৎ অনেক নারী বস্তির দিক থেকে চিৎকার করে উঠল। দেখি মাঠের দক্ষিণ দিকের বস্তির মেয়েছেলেরা মাঠের দিকে আসতে চাইছে আর পাকিস্তানি মিলিটারি মেশিনগান নিয়ে ওদের তাড়াচ্ছে। সামনে চেয়ে দেখি আমাদের থেকে আলাদা করে যেসব সুইপারকে নিয়ে এসেছিল, তাদের গুলি করছে। বুঝলাম, এবার আমাদের পালা। আমাদের আগে যারা লাশ নিয়ে পৌঁছেছিল, তাদেরও দাঁড় করিয়েছে।

আমরা কোনোরকমে দুজনে সুনীলের লাশটি টেনে জড়ো করা লাশগুলোর পশ্চিম দিকে নিয়ে যাই। সামনেই দেখি ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মৃতদেহ, ধুতি পরা, খালি গা। ক্ষতবিক্ষত সারা শরীর। পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। আমার সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল, সে ড. দেবের মৃতদেহ দেখে বলে উঠল, ‘তাঁকেও মেরেছে! তবে আমাদের আর মরতে ভয় কী?’ কী ভেবে আমি ড. দেবের মৃতদেহের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে সুনীলের লাশ ধরা অবস্থাতেই শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তিতে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা আমার তখন ছিল না।

এভাবে ‘মরার মতো’ অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে, বলতে পারব না। একসময় আমার মাথার কাছে মেয়ে ও বাচ্চাদের কান্না শুনতে পেলাম। চোখ মেলে দেখি সুইপার, দারোয়ান ও মালিদের মেয়েরা তাদের মৃত স্বামী, ছেলে, বাবা কিংবা ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। কেউ পানি চাইছে। তাদের কেউ কেউ পানি খাওয়াচ্ছে। মাথা তুলে দেখি যেদিকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের গাড়ি ছিল, সেদিকে তারা নেই। চতুর্দিকে একনজর দেখে নিলাম। মেয়ে ও বাচ্চাদের মধ্য দিয়ে নুয়ে নুয়ে বস্তির মধ্যে গেলাম। আমি বস্তির পশ্চিম দিকের ল্যাট্রিনের শেষটিতে ঢুকে পড়ি।

অনেকক্ষণ কাটালাম সেখানে। একসময় একটা লোক এসে ল্যাট্রিনের দরজায় নাড়া দিল। দরজা নাড়া দেওয়াতে ভাবলাম, এইবার শেষ। নিশ্চয়ই পাকিস্তানি মিলিটারি এসেছে। খুলি না দেখে বলল, ‘বাবু, ভয় নেই, আমি ইদু।’ পুরোনো বই বিক্রি করত রাস্তার ওপারে। বলল, ‘আমি এসেছি মেয়েদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আপনি আছেন শুনে আপনাকেও নিতে এসেছি।’ বলল, ‘রাস্তা এখন পরিষ্কার—কোনো পাকিস্তানি মিলিটারি নেই।’

গায়ে সেই চাপ চাপ রক্ত নিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত