1459
Published on সেপ্টেম্বর 28, 2022জুনাইদ আহমেদ পলকঃ
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকেরা দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং তার নেতা শেখ মুজিবকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। তাই ১৯৪৮ সালে ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি শাসকেরা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও কৌশলী নেতৃত্বে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কাছে ষড়যন্ত্র পরাভূত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের লক্ষ্যও প্রায় অভিন্ন—বঙ্গবন্ধু এবং নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা এবং বাংলাদেশকে নব্য পাকিস্তানে পরিণত করা। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং ৩ নভেম্বর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। দেশ নিমজ্জিত হয় অমানিষার নিকশ কালো অন্ধকারে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক ও আধা গণতন্ত্রী শাসকেরা স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতার অংশীদার করে দীর্ঘ ২১ বছর ধরে দেশ শাসন করে। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে বেছে নেয়। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও দুঃশাসনের মধ্যে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের রাজপথের আন্দোলন দারুণ গতি পায়।জননেত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের অবসান হয়। গণতন্ত্র, বাঙালির ভাত ও ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দেশের জনগণ জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখে। তার নেতৃত্বে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে পাঁচ বছর (১৯৯৬-২০০১) এবং ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন মেয়াদে সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করায় বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের নরঘাতক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন এবং রায় কার্যকর করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দূরদর্শিতায় একসময় যে বাংলাদেশ টিকে থাকবে কি না বলে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। অবকাঠামো, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সমুদ্র এমন কোনো খাত নেই, যেখানে মাইলফলক অর্জন নেই। সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশের সর্ববৃহত্ অবকাঠামো পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার অদম্য সাহস, দৃঢ়তা ও আ্ত্তনির্ভরশীলতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেশে অসম শিক্ষানীতির পরিবর্তে সবার জন্য সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থায় বিনা পয়সায়, এখন প্রতি বছরের প্রথম দিনে শতভাগ শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উক্ষেপণের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ক্লাবের ৫৭তম গর্বিত সদস্য দেশ। অনেক মাইলফলক অর্জনের তালিকায় এ বছরের ডিসেম্বরে যোগ হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেল। বিশ্বসভায় আ্ত্তমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জাদুর পরশে অনন্য উচ্চতায় ডিজিটাল বাংলাদেশ।
মধুমতী নদীবিধৌত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান, নব পর্যায়ের বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা, মাদার অব হিউম্যানিটি, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা। এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন শেখ হাসিনার। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েক বার তাকে কারা নির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। অন্তত ২১ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তমানবী জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনা দক্ষতার অন্যতম সেরা সাফল্য ১৩ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। তার দক্ষ নেতৃত্ব এবং খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও নির্দেশনা এবং তত্ত্বাবধানে ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। দেশে শক্তিশালী আইসিটি খাতে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। উচ্চগতির (ব্রডব্যান্ড) ইন্টারনেট পৌঁছে গেছে ইউনিয়নগুলোতে। বর্তমানে তা গ্রামে যাচ্ছে। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির অধিক। মোবাইল ফোনের সংযোগসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি।
আইসিটি অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে দেশের সফল সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। সরকার ২ হাজার সেবা ডিজিটাইজড করেছে। সারা দেশের প্রায় ৮ হাজার ৫০০টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে প্রতি মাসে ৬০ লাখের বেশি মানুষ সেবা গ্রহণ করছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতি মাসে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের সাফল্যকে তুলে ধরছে। ৯টি হাইটেক/সফটওয়্যার পার্ক/আইটি ইনকিউবেশন সেন্টারে ব্যাবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ই-নথি, জাতীয় তথ্য বাতায়ন, জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩, ই-নামজারি, আরএস খতিয়ান সিস্টেম, কৃষি বাতায়ন, ই-চালান, এক পে, এক শপ, এক সেবা, কিশোর বাতায়ন, মুক্তপাঠ, শিক্ষক বাতায়ন, আই-ল্যাব, করোনা পোর্টাল, মা টেলি হেলথ সার্ভিস, প্রবাস বন্ধু কল সেন্টার, ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম, ডিজিটাল ক্লাসরুমসহ অনলাইনে অসংখ্য সেবা জনগণের জীবনযাত্রা সহজ করেছে। করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনন্য সাফল্য দেখিয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে; যা শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
উদ্ভাবন ও গবেষণা ছাড়া ডিজিটাল অর্থনীতি বিকশিত হতে পারে না। এমন উপলব্ধি থেকে প্রধানমন্ত্রী তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানোর ওপর জোর দেন। একদিকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষায়িত ল্যাব প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে এআই, রোবোটিকসহ ৩৩টি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, অন্যদিকে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকার ৫০০ কোটি টাকা ফান্ড দিয়ে এই আইটি স্টার্টআপদের মেধা বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর মতোই তার সুযোগ্য কন্যা তরুণ প্রজন্মের কাছে এক অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন তারুণ্যের বাতিঘর। বাংলার তরুণেরা এখন ইন্টারনেট শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের আরো দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর পর জননেত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার ১৮ বছর বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণালি সময়, যা আজও অব্যাহত আছে। অর্থনীতি ও উন্নয়ন, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা, পররাষ্ট্রনীতিসহ সব খাতকে প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, একসময়ের দরিদ্রতম দেশটি আজ ৪১তম অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড রিসার্চের (সিইবিআর) সমীক্ষামতে, বর্তমান ধারায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি বিশ্বে ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ওপর ভিত্তি করে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, উদ্ভাবনী, বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞাননির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ এবং উন্নত দেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন, তা একমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনার দ্বারাই সম্ভব। দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য তিনি যে স্বপ্ন দেখছেন, তার বাস্তবায়ন সফল হোক, তিনি দীর্ঘজীবন লাভ করুন—এটাই আমাদের সবার কামনা।
লেখক : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী