1128
Published on জুন 29, 2022ড. প্রণব কুমার পান্ডে:
২৫ জুন ২০২২ বাঙালির ইতিহাসে এক অনন্য দিন হিসেবে পরিগণিত হবে অনাদিকাল। কারণ এই দিনে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। এক অসম্ভবকে সম্ভব করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সামর্থ্য কখনোই উন্নয়নের বাধা হতে পারে না। মানুষের উদ্দেশ্য যদি সৎ থাকে এবং মনে প্রত্যয় থাকে তাহলে যে কোনো অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।
আমাজন পৃথিবীর সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। এর পরই পদ্মার অবস্থান। এই খরস্রোতা ও প্রমক্তা পদ্মার ওপরে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের সক্ষমতার বিষয়টি। এই নির্মাণকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা প্রশংসায় ভাসিয়েছেন বাংলাদেশের এই অর্জনকে।আজকের লেখায় পদ্মা সেতুর কারিগরি দিক কিংবা অর্থনীতির প্রভাব সেই সম্পর্কে আলোকপাত না করে একটু ভিন্ন মাত্রার আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আমি টেলিভিশনের পর্দায় পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ বক্তব্য শুনেছি। তাঁর বক্তব্য শুনে অন্য রকম এক শেখ হাসিনাকে আবিষ্কার করেছি, যিনি অত্যন্ত বিনয়ী এবং আত্মবিশ্বাসী। বক্তব্যের পুরোটা সময় আমি বিমোহিত হয়ে তাঁর কথাগুলো শুনেছি। মাঝে মাঝেই তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছিল। বঙ্গবন্ধু যেমন খুবই দৃঢ় এবং আত্মবিশ্বাসী মনোভাব নিয়ে সব সময় জনগণের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতেন, ঠিক তেমনি ভাবে আজ শেখ হাসিনা আত্মবিশ্বাসের সাথে সুধী সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে এত বড় অর্জন দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেনি। এখানে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অনেক বেশি। পদ্মা সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত জটিলতা অনেক বেশি ছিল। কারণ পদ্মা অসম্ভব খরস্রোতা নদী। সেই খরস্রোতা নদীর ওপরে এই ধরনের একটি মহাযজ্ঞ নির্মাণ করা অত্যন্ত জটিল কাজ ছিল। তাঁর ভাষণের মাধ্যমে একজন যোগ্য নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। তিনি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে পদ্মা সেতুর সার্বিক বিষয়ে আজ তুলে ধরেছেন শ্রোতাদের সামনে। তিনি একদিকে যেমন পদ্মা সেতুর চ্যালেঞ্জগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে দেশি এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন জাতির সামনে।
তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে পদ্মা সেতুকে জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রমাণ করেছে বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালি জাতি চাইলে যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেমন স্বাধীন হয়েছিল, ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পদ্মা সেতু করে দেখিয়েছে। বক্তব্যের মাঝখানে আমি তাঁকে আবেগপ্রবণ হতে দেখেছি, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরে বস্তুতপক্ষে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা এতিম হয়ে যান। তিনি তার ছয় বছরের বিদেশি জীবনের করুণ কাহিনি বর্ণনা করেছেন সংক্ষিপ্তভাবে। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে তাঁরা দুই বোন অন্যরকম জীবন যাপন করছিলেন সে কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর বক্তব্যে।
তিনি তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর প্রবাস জীবন চলাকালে আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করায় তিনি দেশে এসে বাংলাদেশের জনগণকে সেবা করার মাধ্যমে ভালোবাসা অর্জন করেছেন। পরক্ষণেই তিনি আবেগ থেকে বের হয়ে এসে কোনো রকম কটাক্ষ না করে যারা পদ্মা সেতুর সমালোচনা এবং বিরোধিতা করেছিলেন তাদের শুভবুদ্ধি উদয় হওয়ার প্রত্যাশা করেছেন। তিনি কারও প্রতি কোনো রকম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে সবাই মিলে যেন পদ্মা সেতুর অর্জনকে ভাগ করে নিতে পারি- সে বিষয়ে উদাত্ত আহ্বান জানান।
তিনি একই সাথে পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, পদ্মা সেতু তৈরি হলে এবং ব্যবহার শুরু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার সাথে ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ সহজতর হবে এবং সেই অঞ্চলের মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুকে তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেছেন। কারণ পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। আবার একই সাথে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর মোংলা পোর্টের কার্যকর ব্যবহার নিয়েও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
সর্বোপরি তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি হচ্ছে বাংলার মানুষকে এক হওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এসেছে। তিনি বলেছেন, কত কষ্ট করে পদ্মা সেতু তৈরি করেছেন। কীভাবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে? তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
তাঁর পুরো ভাষণটি প্রত্যক্ষ করে আমি এক অনন্য উচ্চতার আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনাকে আবিষ্কার করেছি, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। তাঁকে দেখে অত্যন্ত সাবলীল এবং দৃঢ় মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরে বাংলাদেশে এমন কোনো নেতৃত্ব এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। গত ১৩ বছরে বাংলাদেশের অর্জনে শেখ হাসিনা শুধু দেশে না বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছেন। বাংলাদেশের নেতা থেকে তিনি আঞ্চলিক এবং পরে বৈশ্বিক নেতায় পরিণত হয়েছেন। আজ যার প্রতিচ্ছবি আমরা তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছি। এত আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনাকে বাংলার মানুষ আগে কখনো দেখেছে বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি না।
তিনি তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন এবং আগামী নির্বাচনের বিষয়টিও জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছেন। জনগণকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তাঁর প্রচেষ্টায় জনগণ তাঁর ওপর আস্থা রাখায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। একই সাথে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের জনগণ তাঁর প্রতি আস্থা রাখবে-এ বিষয়টিও তুলে ধরেছেন।
শেখ হাসিনা বক্তব্য প্রদানের সময় তাঁর মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস আমি প্রত্যক্ষ করেছি সেই আত্মবিশ্বাসের ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে-একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। গত ১৩ বছরে শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কি অর্জন করেছে। অতএব তাঁর এই আত্মবিশ্বাস সম্মান জানিয়ে ২০২৩ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের উচিত শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখা। তাঁর প্রতি আস্থা রাখলে বাংলাদেশের উন্নতি হবে এবং বাংলাদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
সৌজন্যেঃ জাগো নিউজ ২৪ ডট কম