আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের সমান্তরাল পথচলাঃ ঐতিহাসিক পাঠপর্যালোচনা

668

Published on জুন 23, 2022
  • Details Image

তন্ময় আহমেদঃ 

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের অন্যান্য দলগুলোর মতো গতানুগতিক কোনো দল নয়। আওয়ামী লীগ অনেক কারণেই অন্যদের থেকে পুরোপুরি আলাদা এবং একেবারেই অনন্য। প্রথমত, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দুই দশকের বেশি সময় আগে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়ত, এই দল প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাঙালি জাতির অধিকার ও মুক্তি অর্জন। তৃতীয়ত, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানিদের জেল-জুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়েই দেশের তৃণমূল পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে এই দল। চতুর্থত, বাঙালি জাতিকে একটি মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র উপহার দেওয়াই ছিল এই দলের মূল উদ্দেশ্য। পঞ্চমত, প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চেষ্টা করার কারণে স্বাধীনতার পরেও দুই দশকের অধিক সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে এই দলের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের রক্তে বারবার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে, কিন্তু কখনো এই দল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। তাই বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রতিষ্ঠিত এই দলটিকে নিয়েই আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছেন।

তাহলে আসুন, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের যুগলযাত্রা সম্পর্কে সংক্ষেপে একবার ইতিহাসে চোখ ফেলি। আসুন জেনে নেই ১৯৪৭ সালের আগে অখণ্ড ভারতবর্ষের সময়কার একটি ছোট্ট তথ্য, সেই সময় অখণ্ড বাংলার অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের এক ছাত্র নেতার কথা। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান দেশ ভাগের আগেই ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। অখণ্ড বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য ছাত্রনেতা হিসেবে দেশভাগের আগেই জনপ্রিয় তরুণ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবিলা এবং প্রকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কাজ করেছেন তৎকালীন পূর্ব-বাংলা থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে। যারফলে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে খুব দ্রুতই সংগঠন গুছিয়ে নিতে পেরেছিলেন তিনি। তার এই সাংগঠনিক তৎপরতা নতুন বা আকস্মিক কিছু নয়। আসুন এবার মূল প্রসঙ্গ থেকে একবার ঘুরে আসি। যার শুরুটা ছিল দেশভাগ দিয়ে।

মুখোশ খুলে ফেলে পাকিস্তানিরা, বাঙালিদের সংগঠিত করেন শেখ মুজিব:

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পরপরই বাঙালি জাতিকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানিরা। শুরুতেই তারা আমাদের বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। শুধু তাই নয় লেখার ক্ষেত্রেও বাংলা বর্ণমালার ব্যবহার বন্ধ করার পরিকল্পনা করে। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল বাঙালি জাতি উর্দুতে কথা বলবে এবং শিক্ষাগ্রহণ করবে। আর অল্প-শিক্ষিতরা বাঙালিরাও লিখবে রোমান হরফে, অর্থাৎ বাংলা বাক্য লিখলেও তা লিখবে উর্দু বর্ণমালার মাধ্যমে (আমরা এখন মোবাইল ফোনে ইংলিশ ফন্ট ব্যবহার করে যেমন বাংলা শব্দ লিখি, ঠিক সেভাবে)। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ হওয়ার পর, তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ তৎকালীন পূর্ব-বাংলার (বাংলাদেশ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। ঠিক এরকম একটি পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন অখণ্ড বাংলার প্রভাবশালী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলের পত্তন ঘটান তিনি।

পবিত্র ধর্মকে ধোঁকা হিসেবে ব্যবহার করে সরলপ্রাণ বাঙালি জাতিকে বোকা বানিয়ে রেখে শোষণ শুরু করে ধর্মব্যবসায়ী পাকিস্তানি চক্র। কিন্তু প্রতিবাদ করেন জনমত গঠন করতে থাকেন যে সচেতন ছাত্রছাত্রীরা, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। যেভাবে সবাইকে সংগঠিত করতে থাকেন তিনি, তাতে অল্প সময়ের মধ্যেই পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সারা দেশের মানুষের চোখ খুলতে শুরু করে। ফলে বারবার তাকে জেলে বন্দি করে পাকিস্তানি জান্তারা। তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সমন্বয়ে ছাত্রলীগের মাতৃসংগঠন হিসেবে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। দলের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন তরুণ নেতা শেখ মুজিব।

ভাষা আন্দোলন ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন: গণমানুষের দলে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ:

এরপর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন। যার চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার সমাবেশে পাকিস্তানিদের গুলি চালানোর মাধ্যমে। শহীদদের রক্তে রঞ্জিত ঞয় রাজপথ। পাকিস্তানিদের ধর্মব্যবসার মুখোশ খুলে পড়ে ক্রমশ। দলের ভারপ্রপাত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সারা দেশ চষে বেড়াতে শুরু করেন শেখ মুজিব। যার ফলে ১৯৫৪ সালে পূর্ব-বঙ্গের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী মুসলীম লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। কট্টর মুসলিম লীগের ধর্ম ব্যবসা ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যায় এই নির্বাচনের মাধ্যমে।

দেশজুড়ে গণমানুষের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয় আওয়ামী মুসলীগ লীগ ও নৌকা প্রতীক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপামর বাঙালির দলে পরিণত হয় এটি এবং দেশব্যাপী শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন এই দলের জনপ্রিয় মুখপাত্র। ফলে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি অপসারণ করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে বাংলার গণমানুষের দলে রূপান্তরিত করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার নামে ধোঁকা হিসেবে যেনো আর কেউ কোনো পবিত্র ধর্মকে অপব্যবহার করতে না পারে, মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই যেনো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হয়, যাতে একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে- সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় এই উদ্যোগের মাধ্যমে।

কিন্তু পাকিস্তানিদের দমনপীড়ন থেমে থাকে না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পর অর্থনৈতিক আগ্রাসনও তীব্র আকার ধারণ করে। এরই মধ্যে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি জান্তারা রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবকে জেলে নেয়। ফলে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা রাজনীতি ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু জেল থেকে বের হওয়ার পর ১৯৬৪ সালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠক ডাকেন অদম্য সাহসী নেতা শেখ মুজিব। সেই বৈঠকের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবন দান করেন তিনি, একই সঙ্গে দেশজুড়ে সংগঠনকে নতুন করে গড়ে তোলা শুরু করেন।

একপর্যায়ে, এই ভূখণ্ডের গণমানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য ১৯৬৬ সালে 'বাঙালির বাঁচার দাবি' খ্যাত 'ছয় দফা' ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। ছয় দফার প্রচারণায় আবারো তিনি ছুটে বেড়ান দেশের প্রতিটি প্রান্তে। এরমধ্যেই আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচতি হন তিনি। প্রথমবারের মতো ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক সবাই একযোগে ছয় দফার দাবিতে রাজপথে নামে তার আহ্বানে। দেশজুড়ে শুরু গণজাগরণ। ফলে শেখ মুজিবকে বন্দি করে আন্দোলন দমানোর নীলনকশা করে পাকিস্তানিরা। জেলে থাকা অবস্থাতেই তার নামে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়ে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দিয়ে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ১৯৬৯ সালে সর্বোস্তরের জনগণ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছাড়তে বাধ্য হয় পাকিস্তানি জান্তারা।

এরপরেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের হর্ষধ্বনির মাধ্যমে ২৩ফেব্রুয়ারি 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিকে ভূষিত করা হয় তাকে। বাঙালির একক কণ্ঠস্বরে পরিণত হন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। পদত্যাগ বাধ্য হয় সামরিক জান্তা আইয়ুব খান। এরপর, ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর সভায় এই ভূখণ্ডকে 'বাংলাদেশ' বলে অভিহিত করেন বঙ্গবন্ধু।

মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত ধাপ বাংলাদেশের স্বাধীনতা:

বঙ্গবন্ধুর দাবির পরিপ্রক্ষিতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম অবাধ জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দেয় নতুন জান্তা প্রধান ইয়াহিয়া খান। সেই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়া ভোট দেয় এই ভূখণ্ডের মানুষ। ফলে আওয়ামী লীগের হাত ধরে পুরো পাকিস্তান শাসনের অধিকার লাভ করে বাঙালি জাতি। কিন্তু পাকিস্তানিরা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এরকম পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় বাংলায়। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের জনসভায় জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। ফলে পুরো বাঙালি জাতি তার নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে। ৭ মার্চ দশ লাখের অধিক মানুষের সমাবেশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রণকৌশল ও যুদ্ধের দিকনির্দিশনা ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়ার সাথে সাথেই অয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানিদের রেডিওতে সেই ঘোষণা ধরা পড়ে।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি জান্তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে বন্দি রাখা হয় তাকে। গোপন সামরিক বিচারের মাধ্যমে হত্যার চেষ্টা করা। তবে বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ নেতারা সার্বভৌম বাংলাদেশের সরকার গঠন করে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রণাঙ্গণ। অবশেষে ত্রিশ লাখ শহীদ ও চার লাখ মা-বোনের অপরিসীম ত্যাগের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে বীর বাঙালি। এরপর পাকিস্তানের কারাগারে আসামিদের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘৃণ্যভাবে হত্যার অপচেষ্টা করে পাকিস্তানিরা। তবে আন্তর্জাতিক চাপে অবশেষে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তারা।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে, লন্ডন হয়ে, ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন জাতির পিতা। পূর্ণতা পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এরপর মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পান তিনি। এরমধ্যেই বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি অর্জন, ধ্বংসস্তূপে পরিণত দেশ পুনর্গঠন, কৃষি ব্যবস্থা, সামাজিক ও অর্থনীতি সংস্কার, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও নাশকতা মোকাবিলা করেও দেশকে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের ইন্ধনে এদেশেরই কিছু দেশদ্রোহী বর্বররা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করে তাকে। এরপর জেলের মধ্যে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বঙ্গবন্ধুর সহচর শীর্ষ চার আওয়ামী লীগ নেতাকে। শুধু তাই নয়, দেশব্যাপী হত্যা করা হয় কয়েক হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। স্বৈরাচারদের জেল-জুলুম-নির্যাতনে দিশেহারা হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। আওয়ামী লীগকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার অপচেষ্টাও করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র।

শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম ও বাংলাদেশের নবযাত্রা:

তবে জনদাবির মুখে ১৯৮১ সালের দলীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এরপর দীর্ঘ ছয় বছরের নির্বাসন শেষে ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। তিল তিল করে গড়ে তুলতে শুরু করেন প্রায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগকে। স্বৈরাচারদের বুলেট-বোমা প্রতিনিয়তই ধাওয়া করে তাকে, প্রিয় নেত্রীকে স্বৈরাচার ও উগ্রবাদী শক্তির হামলা থেকে বাঁচাতে প্রাণ বিসর্জন দেন আওয়ামী লীগের শতাধিক কর্মী। দেশের গণমানুষ এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নিজের প্রাণ বাজি রেখে মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকারের জন্য রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন শেখ হাসিনা। ফলে স্বৈরাচারের পতন ঘটে এবং ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র ও সুক্ষ্ম কারচুপির কারণে ভোট বেশি পেয়েও আসন সংখ্যায় পিছিয়ে যায় আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পৃষ্ঠপোষক স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া। আওয়ামী প্রধান হিসেবে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের তীব্র দাবির মুখে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে বাধ্য হন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনার হাত ধরেই দেশে ফিরেই প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা।

এদিকে যে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ-না ভোট নামের নাটকের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তার স্ত্রীও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একদলীয় নির্বাচন করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরোধী দরের আসনে বসায়। তবে জনগণের গণআন্দোলনের ফলে পদত্যাগে বাধ্য হয় খালেদা জিয়া। জুন মাসে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে তুমুল জনপ্রিয় ভোটে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এরপর দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি, ভারতের সাথে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করেন শেখ হাসিনা।

১৯৯৮ সালের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বন্যা মোকাবিলা করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দুর্যোগ মোকাবিলার রোল মডেলে পরিণত করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারেরই এই আমলেই খাদ্য ঘাটতি পূরণ করে প্রথমবারের মতো খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। ভূমিহীন-গৃহহীনদের স্বাবলম্বী করে দেওয়ার জন্য গ্রহণ করেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। যার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত দশ লক্ষাধিক মানুষকে জমি ও ঘর দেওয়া হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষের সুরক্ষার জন্য নিয়েছে বহুমুখী সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা, যার আওতায় সুবিধা পাচ্ছে প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ।

বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ একসূত্রে গাঁথা:

বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় কল্যাণমুখী সমাজ গঠনের জন্য কৃষকবান্ধব নীতি গ্রহণ করেছে। কৃষি-উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্পের বিকাশ ঘটানোই আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক নীতি। এছাড়াও শিক্ষার আলোয় আলোকিত নতুন প্রন্মই পারে তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে। তাই আওয়ামী লীগ সরকার দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে বিভিন্নভাবে প্রণোদনা ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সুস্থ-সবল-কর্মক্ষম নাগরিক সমাজ গঠন করার উদ্দেশ্য মা ও শিশুদের বিশেষ সুরক্ষার আওতায় এনেছে আওয়ামী লীগ সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার পরিকল্পনাতেই গ্রামে গ্রামে স্থাপন করা হয়েছে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র। উগ্রতা ও অমাবশ্যায় অন্ধকার কাটিয়ে দেশ ঝলমল করছে শতভাত বিদ্যুতায়নে। উন্নত অবকাঠামোর মাধ্যমে সারা দেশকে একসুতোয় গাঁথা হয়েছে- যার সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হলো পদ্মাসেতু। সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এক বিস্ময়কর স্থাপনা হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে এটি।

আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদীর ওপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম একটি বড় সাফল্য, একই সঙ্গে দেশের উন্নয়নের একটি মাইলফলক এটি। মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্য অর্জনের পর, উন্নত রাষ্ট্র গঠনের পথে ধাবমান বাংলাদেশের প্রথম মাইলফলক এই সেতু। এটি এখন বিশ্বজুড়ে বাঙালির মর্যাদার প্রতীক। বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের বুকে উন্নত শিরের যে বাঙালি জাতিকে দেখতে চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাত ধরে আজ তা অর্জন করেছে বাঙালি জাতি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশ একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- আওয়ামী ও বাংলাদেশে একারণেই একে অপরের পরিপূরক। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাঙালি জাতি নিশ্চই একদিন প্রকৃত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে, সেদিন পূর্ণাঙ্গভাবে মানবিক ও কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের অন্যতম শান্তুপূর্ণ ও স্থিতিশীল জাতি হিসেবে সবাই অনুকরণ করবে আমাদের--সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আপনার সন্তানদের জন্য বসবাসযোগ্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে জয় বাংলা বলে আগে বাড়ুন; গুজববাদ, উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদকে না বলুন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখকঃ কোঅর্ডিনেটর, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই); সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বুয়েট ছাত্রলীগ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত