859
Published on জুন 18, 2022অঞ্জন রায়:
একটি সেতু তখনই একটি দেশের গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠে যখন দেশের মানুষের কাছে সেই সেতুটি নিজস্ব মমত্বের চিন্হে পরিনত হয়। হ্যা। সেটাই হয়ে উঠেছে আমাদের পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে। নির্মানের কাজ শুরু হওয়ার আগেই পদ্মাসেতু নিয়ে শুরু হয়েছিলো ষড়যন্ত্র– দেশি পন্ডিত থেকে বিদেশি লবিস্ট, সাচ্চা আলবদর রাজাকার থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া দু একজন– সবাই একজোট হলেন যে কোনও ভাবে বাংলাদেশে যাতে পদ্মাসেতু না হয় সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ছক নিয়ে।
গরম হয়ে উঠলো খবরের কাগজের পাতাগুলো, তাপ ছড়ালো টেলিভিশন টকশোগুলোতে, তখনও ফেসবুক এতোটা গণ হয়ে ওঠেনি– ইউটিউবের বাজারও জমে ওঠেনি, তবু সেখানেও ব্যাপক পান্ডিত্যের তুফান। কেউ কেউ যেমন সেতুর অর্থ বরাদ্দের আগেই খুঁজে পেলেন বিশাল দূর্নীতি, আবার কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলেন এই সেতু কখনো নির্মান করতে পারবে না সেই সময়ের সরকার। কিন্তু সব কিছুকে উড়িয়ে দিয়ে সেতুটি নির্মান হয়ে গেল।
বিশ্বব্যাংকের টাকায় নয়, আমাদের নিজেদের অর্থায়নে। আর যে সরকার সেতুটির স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কাছে এসেছিলো– সেই সরকারের ধারাবাহিকতার মাঝেই পদ্মাসেতুর প্রথম থেকে শেষ পিলারটা পর্যন্ত তৈরি হলো– এখন আমাদের চোখের সামনে পূর্ণ নির্মিত পদ্মাসেতু। বঙ্গবন্ধুর সন্তান দেখিয়ে দিলেন প্রতিশ্রুতি না– তিন সেই মানুষ যিনি প্রতিশ্রুতির প্রতিটি অংশ বাস্তবায়ন করতে জানেন।
আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বাজে দিক হলো– প্রতিপক্ষকে সফলতা না দিতে দেশের মানুষের সরাসরি ক্ষতি করা। সেই ক্ষেত্রেও পদ্মাসেতু এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যারা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এখনো করছেন- তারা কিন্তু খুব ভালো করেই জানতেন এই সেতুর নির্মান দেশের বিশাল একটি জনপদের মানুষের কাছে কতটা জরুরী।
তারা জানতেন এই সেতুটির নির্মানের ফলে আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বড় পজেটিভ প্রভাব পড়বে। প্রান্তিক মানুষ থেকে বড় ব্যাবসায়ী প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে পদ্মাসেতুর সুফল পাবেন। কিন্ত তবুও সর্বোচ্চ চেষ্টা চলেছে পদ্মাসেতু যাতে আওয়ামী লীগ সরকার নির্মান না করতে পারে সেই জন্য।
মিথ্যাচারের ইমেইল চালাচালি, বিস্তর অসত্য তথ্যের উৎসব চালানোর সময়ে তাদের একবারও মনে হয়নি-পদ্মাসেতু নির্মিত হলে সরাসরি উপকৃত হবেন দেশের মানুষ। অবশ্য বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্র যখন প্রধান বিষয়, তখন সাধারন মানুষ গৌন হয়ে যায়। যায় বলেই আমরা নিকট অতীতে দেখেছি আন্দোলন আর অবরোধের নামে মানুষ পোড়ানোর অজস্র ঘটনা।
দেখেছি সরাসরি জ্ঙ্গীদের হাতে হাত রেখে দেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের রাজবন্দী হিসেবে উল্লেখ করে তাদের মুক্তি চাওয়া, দেখেছি যুদ্ধপরাধীদের দন্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকার ঘটনা।
এসব দৃষ্টান্তের কারনেই পদ্মাসেতু নিয়ে অগনিত মিথ্যাচার বা ষড়যন্ত্র আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয়নি। মনে হয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে কতোটা নীচতার আশ্রয় নেয়া যায়, তারই কিছু দৃষ্টান্ত ইতিহাসের সংগ্রহে তুলে দেয়ার জন্য কিছু রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, দাদন ব্যাবসায়ীরা নিজেদের স্বরুপ রেখে দিলেন সময়ের কাছে। যা আজ যেমন এই আমাকে বা আমাদের বিস্মিত করেছে– আজ থেকে ৫০ বছর পরেও আগামী প্রজন্মের মানুষদের তেমন বিস্মিত করবে। ইতিহাসের কাঠগড়া খুব নির্মম– সেখানে কোনও ষড়যন্ত্রকারীই কখনো নিজের চেহারা লুকাতে পারেন নাই।
আমার মনে পরে সেই ছোট্টবেলায় পাবনা থেকে ঢাকাতে আসতে দুটো ফেরী পারি দিতে হতো। আজ সময়ের পথ যন্ত্রণা আজকের প্রজম্ম ভাবতেও পারবে না। কারন এখন বঙ্গবন্ধু সেতুর কারনে সেই পথের কষ্ট হারিয়ে গিয়েছে অনেক বছর। ঠিক তেমনই লাখো মানুষের পদ্মাপারি দেয়ার কষ্ট, এম্বুলেন্সে আটকে থাকা অসুস্থ মানুষের কষ্ট- স্বজনদের চিন্তা এসব কিছুর মুক্তি ঘটতে চলেছে পদ্মাসেতুর মাঝে দিয়েই।
দেশের অর্থনীতির বড় একটা বাঁক বদলের দৃষ্টান্তও হবে আমাদের পদ্মাসেতু। আর সেই সেতুটির নির্মাণে মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের আরেক অনন্য উচ্চতার পৌঁছালেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা গর্ব করে বলতে পারি– আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু স্বপ্ন দেখান না। শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে নিজের স্বকীয়তা ও স্বক্ষমতায় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দেন– দিন বদলের সনদের প্রতিটি অক্ষর, শব্দ, বাক্যের শক্তি।
জানি, আর মাত্র কয়েকদিন পরই লাখো মানুষ চলাচল করবেন পদ্মাসেতু দিয়ে। যারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এখনো করছেন- আগামীতে করবেন। তারাও চলাচল করবেন। হয়তো সেতুতে চলার সময়ে চালককে বলবেন গাড়ীর গতি কমাতে। কাঁচ নামিয়ে মুক্ত বাতাস নেবেন বুক ভরে। কিন্তু সেই সময়ে কি তাদের নিজের মধ্যে একটুও অপরাধবোধ বা আক্ষেপ কাজ করবে না? মনে মনে হলেও তারা কি অনুতপ্ত হবেন না– নিজেদের কুৎসিত কৃতকর্মের কথা ভেবে? জানি না তারা কি ভাববেন, তবে তাদের চেহারাগুলো কিন্তু সাধারন মানুষও চিনে গিয়েছে– এটুকু অন্তত তারা বুঝলে সেটিও আগামীর জন্য কল্যানকর।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক।