1373
Published on জুন 11, 2022মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারীঃ
ফিরে এলো ১১ জুন । ২০০৮ সালের এই দিনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ৩৩১ দিন কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন। তখন ক্ষমতায় ছিল ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অনেকে এটিকে ইয়াজউদ্দিন-মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার বলে থাকেন। ইয়াজউদ্দিন ছিলেন রাষ্ট্রপতি, মইনুদ্দিন সেনাপ্রধান এবং ফখরুদ্দিন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ প্রধান উপদেষ্টা। সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার কথা ছিল সেটি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লঙ্ঘিত হয়। ওইদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মেয়াদ শেষে দায়িত্ব হস্তান্তর না করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদেকে প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে প্ররোচিত করেছিলেন। ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদও গ্রহণ করেন। এই পদ তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরাসরি গ্রহণ করতে পারেন না। ৫৮ অনুচ্ছেদের ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে সর্বশেষ অপশন তথা পছন্দ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এটি ছিল সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘন। একারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথম থেকেই সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনিয়ম বাড়তেই থাকে। রাস্তায় আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়াও ব্যাপকতর হতে থাকে। ডিসেম্বরে সরকারের চারজন উপদেষ্টাও পদত্যাগ করেন। তারপরও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহমেদ চারদলীয় জোটের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হচ্ছিল। সব রাজনৈতিক দলের আন্দোলন, বিরোধিতা ও অংশগ্রহণহীন অবস্থাতেই একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি চলছিল।
এমনকি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চারদলীয় জোটের বিভিন্ন প্রার্থীকেও বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এর ফলে দেশব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী এবং সুশীল সমাজের সমর্থনে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। ভেঙে যায় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদের কোথাও এমন বিধান ছিল না। তারপরও দেশের মানুষ মনে করেছিল যে পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে যাচ্ছিল তা থেকে জাতি মুক্তি পেয়েছে। ফখরুদ্দিনের নতুন সরকার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার। কিন্তু অচিরেই এই সরকারের গতিপ্রকৃতি বদলে যেতে থাকে। সামরিক বাহিনী প্রধান মইনুদ্দিন আহমেদ এবং উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বেআইনি উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে এটি সামরিক-ব্যাকড সরকারের রূপ নিতে থাকে। মইনুদ্দিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন সামরিক শীর্ষকর্মকর্তা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং আলোচনায় চলে আসছিলেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ তখন পিছিয়ে যেতে থাকে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে চোখের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার পর তাকে দেশে ফিরে আসতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তিনি সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন। সামরিকসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে ১৬ জুলাই ধানমন্ডির সুধাসদন থেকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা রুজু করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রায় ২ হাজার পুলিশ তার বাসভবনের এলাকা ঘেরাও করে।
সেখান থেকে তাকে সংসদ ভবনের পাশে অস্থায়ী জেলখানায় আটক রাখা হয়। সেখানেই অস্থায়ী আদালত বসানো হয়। আদালতে বিভিন্ন মামলার শুনানিও চলতে শুরু করে। বোঝাই যাচ্ছিল সামরিকসমর্থিত মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার টার্গেট করেছিল। কিন্তু দেশে তখন জোট সরকারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, নির্বাচনকে কলঙ্কিত করা ইত্যাদি অভিযোগে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের অবস্থানে থেকে আন্দোলন করে। কিন্তু সরকারি দল বিএনপি-জামায়াত ২০০১ সাল থেকে যেসব অপরাধ ও অপকর্ম সংঘটিত করেছিল সেসবের কারণে তীব্র ক্ষোভ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। অথচ সামরিকসমর্থিত সরকার বিএনপি-জামায়াতের ব্যাপারে ততটা আগ্রহ না দেখিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের আক্রোশ প্রকাশ করায় মানুষ সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠে।
তেমন প্রেক্ষাপটে সরকার বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকেও বন্দি করে অস্থায়ী কারাগারে নিয়ে আসে। দুই দলকেই তখন ভাঙার উদ্যোগও প্রকাশ্যে নেয়া হতে থাকে, গঠিত হতে থাকে সেনাসমর্থিত কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাতে বাদ যাননি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসও। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংস্কারের ধুয়া তুলে সংস্কারবাদী গ্রুপ সৃষ্টি করা হয়। তবে বিএনপির একটি প্রভাবশালী অংশ সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়া এবং মেজর (অব.) হাফিজের নেতৃত্বে আলাদা সংস্কারবাদী দল সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলা হলেও দলে কোনো ভাঙন সৃষ্টি হয়নি ।
২০০৮ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যেই সংকট বেড়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। দেশে তখন একদিকে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহলের মধ্যে সরকারের অভ্যন্তরে সেনাসমর্থিত কিছু কর্মকর্তার বাড়াবাড়িতে অসন্তুষ্টি বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তখন খাদ্যসংকট এবং অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে যায়। ফলে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনায় ক্রমেই ব্যর্থ হতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করলে তা ব্যাপকভাবে সমর্থন লাভ করতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভ্যন্তরে ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়ে মতভেদও বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোও প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। আন্তর্জাতিক মহল থেকে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার চাপ বাড়তে থাকে। অস্থায়ী কারাগারে বন্দি শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়লে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা খুব দ্রুতই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আন্দোলনে কাবু করে ফেলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যেও তখন একটি অংশ নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করা এবং সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের মনোভাব পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
অপরদিকে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ছবিযুক্ত ভোটার আইডি কার্ড এবং নির্বাচনি আচরণবিধি সংস্কার করে। আওয়ামী লীগের আন্দোলন করা এবং নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । কিন্তু বিএনপির অবস্থানটি তখন নড়বড়ে ছিল। সেই অবস্থায় শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার জন্য আদালত ৮ সপ্তাহের জামিনের অনুমতি প্রদান করেন।
১১ জুন মুক্তিলাভের পর শেখ হাসিনা চোখের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন এবং স্থায়ী জামিন লাভ করেন।
১১ জুন শেখ হাসিনার মুক্তিলাভের পর তার নেতৃত্বে দলকে সংগঠিত করার উদ্যোগ জোরদার হয়। দেশের মানুষের মধ্যেও শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন বেড়ে যেতে থাকে। মেয়াদ শেষ হওয়া সিটি করপোরেশনে নির্বাচন নতুন ভোটার আইডি কার্ডে অনুষ্ঠিত করার আয়োজন করা হয়। বরিশাল, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, ও খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। অন্যদিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
নতুন নির্বাচন কমিশন সফলভাবে এসব সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আয়োজন করে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। ২০০৬-০৭ সালে নির্বাচন নিয়ে দেশে যে চরম অরাজকতা চারদলীয় জোট সৃষ্টি করেছিল; এরই প্রতিক্রিয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে পড়ে। সেই আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা। তিনি তখন ১৪ দল ও জাতীয় পার্টির সমন্বয়ে গঠিত মহাজোটেরও প্রধান।
২০০১ সাল পরবর্তী সময় থেকে দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলন চালাতে গিয়ে তিনি এবং আওয়ামী লীগ ২১ আগস্টের মতো ন্যক্কারজনক গ্রেনেড হামলার শিকার হয়। এরপর গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার অর্জনের জন্য দেশে যে আন্দোলন সূচিত হয় তিনি তার শীর্ষনেতা হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত হন। ১/১১-এর সরকার তাকে গ্রেপ্তার করার পর তিনি আরও বেশি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ইয়াজউদ্দিন, মইনুদ্দিন ও ফখরুদ্দিনের সরকার ২ বছর অবৈধভাবে যেমনি ক্ষমতায় ছিল, একইভাবে রাজনীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করায় ওই সরকার এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধেও মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
সেই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন-প্রাক্কালে জনগণের কাছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, উন্নয়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ নির্মূল ইত্যাদি রাজনৈতিক ইস্যুর প্রধান নেতারূপে বিবেচিত হন। তিনি ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ ‘দিনবদলের সনদ রূপকল্প ২০২১’ উপস্থাপন করে সেই প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি করেন। নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করা নিয়ে দোদুল্যমান ছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে, জনগণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটকে নিরঙ্কুশ বিজয় প্রদান করে। শেখ হাসিনা দীর্ঘ এই আন্দোলন সংগ্রাম এবং কারা ভোগের প্রতিদান হিসেবে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন। সেই থেকে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়ন, প্রত্যাশা পূরণ এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দান করে আসছেন। এবার কারামুক্তির ১৪ বছরপূর্তি উপলক্ষে তিনি জাতিকে পদ্মা সেতু উপহার দিতে যাচ্ছেন।
লেখক: গবেষক, অধ্যাপক।