1988
Published on জুন 9, 2022১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে বর্বরভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই আকস্মিক আঘাতে স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ থমকে যায়। এরপর একই বছরের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও জাতীয় চার নেতাকে। এরপর ৭ নভেম্বর সেনানিবাসেও বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে সেই খুনি চক্রটি। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডারসহ সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় সেদিন। এমনকি সেক্টর কমান্ডারদের স্ত্রী-সন্তানরাও রেহাই পায়নি সেই বর্বরতা থেকে। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় এই খুনিরা নিজেদের সংগঠিত করে এবং এরশাদের সময় ফ্রিডম পার্টি গঠন করে। এরপর ১৯৯১ সাল থেকে খালেদা জিয়ার মদতপুষ্ট হয়ে দেশজুড়ে আবারো তাণ্ডব চালায় এই চক্রটি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লোক দেখানো এক ভোটের মাধ্যমে এই খুনিদের দলকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসার সুযোগও করে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।
সম্প্রতি এই বিষয়গুলো আবারো আলোচনায় এসেছে একটি স্লোগানের কারণে। কারণ- বিএনপি এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা '৭৫ এর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার' শীর্ষক ধ্বংসাত্মক স্লোগানের মাধ্যমে আবারো দেশে হত্যাযজ্ঞ ও নাশকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এই স্লোগানের মোটিভ খুবই স্পষ্ট এই কারণে যে: এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জেলের মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা ও ৭ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাকেই ইঙ্গিত করা হয়। '৭৫ এর হাতিয়ার' বলতে মূলত এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার কুশীলবদেরই বোঝানো হয়।
৭৫ এর হাতিয়ার এবং ইতিহাসের ঘৃণ্য কালো অধ্যায়
১৯৭৫ সাল বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক বেদনাবহ বছর। দেশাদ্রোহীদের জান্তব হুংকার এবং দেশপ্রমিকদের পবিত্র রক্তে বাংলার মাটি ভিজে যাওয়ার কালো অধ্যায় বহন করে চলেছে এই সালটি। বিএনপির নেতাকর্মীরা '৭৫ এর হাতিয়ার' শীর্ষক যে স্লোগান দেয়, সেই স্লোগানের পেছনের ইতিহাস অতি জঘন্য। মূলত '৭৫ এর হাতিয়ার' বলতে তারা স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দল ফ্রিডম পার্টির পেশিশক্তি প্রদর্শন ও তাদের হঠকারিতাকেই বুঝিয়ে থাকে।
সম্প্রতি ছাত্রদলের নেতারা এই স্লোগান দেওয়ার কারণে সারা দেশের মানুষের কাছে সমালোচিত হয়েছে। পরে এই স্লোগানের ব্যাখ্যা হিসেবে তারা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের লড়াইকে বিপ্লব হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ৭ নভেম্বর কোনো বিপ্লব ঘটেনি কোথাও। এই দিনটিতে ক্ষমতালোভী জিয়া সেনানিবাসে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে নিজে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
৭ নভেম্বর বিপ্লবের নামে যে নাশকতা চালানো হয়, সেটা আদৌ কোনো বিপ্লব নয়। কারণ, সারা দেশের একটি মানুষও এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। জনগণের জনস্রোত ছাড়া পৃথিবীতে কখনোই কোনো বিপ্লব হয়নি। সেনাছাউনির বিশৃঙ্খলাকে কেউ কখনো বিপ্লব বলে না। ওই সময়ের পত্রপত্রিকাগুলো ঘেঁটে দেখুন। সারা দেশের কোন স্থানে জনসাধারণের কোনো তৎপরতা খুঁজে পাবেন না। সেনানিবাস ছাড়া সারা দেশ ছিল খুব স্বাভাবিক, কিছুটা অপ্রস্তুত ও ভীতসন্ত্রস্ত।
৭ নভেম্বর মূলত শুধু সেনানিবাসের ভেতরে থাকা জিয়াউর রহমানের মদতপুষ্ট কিছু সেনা সদস্যের (পুরো সেনাবাহিনী নয়) বর্বর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠার দিন। সেনানিবাসে উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে ফেলে, সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় এদিন। এই নাশকতায় নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধকালীন 'কে ফোর্সের অধিনায়ক' ও ক্রাক প্লাটুনের স্বপ্নদ্রষ্টা সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, সেক্টর কমান্ডার এটিএম হায়দার বীর বিক্রম, সাব সেক্টর কমান্ডার কে এন হুদা বীর উত্তমসহ অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। এমনকি সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী বীর উত্তমকে নিজ বাসায় না পেয়ে তার স্ত্রী নাজিয়া খামনকেও হত্যা করে জিয়াউর রহমানের খুনি বাহিনী। ইতিহাস বলে, ৭৫ এর হাতিয়ার বলতে এই রক্তপিপাসু খুনি চক্রকেই বোঝানো হয়, যারা পরবর্তীতে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনাকে বিনাবিচারে হত্যা করেছে এবং দেশজুড়ে চালিয়েছে ত্রাসের রাজত্ব।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনানিবাসে অস্থিরতা সৃষ্টি করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মমভাবে হত্যার কুশীলব যারা, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পেছনেও রয়েছে সেই একই শক্তি। এরাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার অন্যতম সহচর ও জাতীয় চার নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢুকায় এবং ৩ নভেম্বর প্রকাশ্যে জেলের ভেতরেই তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। সবকিছুর নেপথ্যে ছিল কালো চশমা পরিহিত যে খুনি জেনারেল, সেই ব্যক্তিটিই হলো জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর সেনাপ্রধানের পদে থাকা অবস্থায় ১৯৭৮ সালে অবৈধভাবে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করে সে। আর তখন থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীরা এই নৃশংস স্লোগান দিতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে নিজের স্বার্থে তৈরি করা সেই দানবীয় হাতিয়ারেই ১৯৮১ সালে প্রাণ হারায় জিয়া। খুনি জিয়ার তৈরি সেই ঘাতক বাহিনী তথা '৭৫ এর হাতিয়ার' ১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জিয়ার সঙ্গেই কবরে চলে যায়।
কিন্তু বিএনপির মুখ থেকে সেই স্লোগান ততদিনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তথা ফ্রিডম পার্টির দুর্বৃত্তরা। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে ও গ্রেনেড মারে তারা। এরপর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নামে স্লোগান দিতে দিতে চলে যায়। সেই সময়ও এই খুনিচক্র '৭৫ এর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার' বলে স্লোগান দিয়েছিল।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে, ফ্রিডম পার্টির খুনিদের প্রকাশ্য কার্যক্রম কমে যায়। কিন্তু '৭৫ এর হাতিয়ার' শীর্ষক রক্তপিপাসু ও পাশবিক এই স্লোগান আবারো ফিরে আসে বিএনপি নেতাকর্মীদের কণ্ঠে। সেই ধারাবাহিকতাতেই বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো এখনও এই ন্যাক্কারজনক স্লোগানের মাধ্যমে জাতিকে রক্তাক্ত করা এবং জাতীয় ক্ষতি সাধনের প্রত্যক্ষ হুমকি দিয়ে আসছে।
৭৫-এর হাতিয়ার: স্লোগান নয়, জাতীয় হুমকি
৭৫-এর হাতিয়ার বলতে মূলত রাজনৈতিক কিছুই নয়, বরং খুন-হত্যা ও নাশকতার ভয় দেখানো হয় শান্তিপ্রিয় বাঙালি জাতিকে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা, জাতীয় নেতাদের বর্বরভাবে বন্দি অবস্থায় খুন করা এবং সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশবিকভাবে হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় বিএনপি। এসব ভয়াল ঘটনার কথা জাতিকে মনে করিয়ে দিয়ে, নতুন করে হিংস্র ঘটনা বা নাশকতা ঘটানোর হুমকি দেওয়া হয় এই স্লোগানের মাধ্যমে।
‘৭১ এর হাতিয়ার’ বলতে দেশের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের মতো করে জেগে ওঠার বা জাতীয় জাগরণের যে বার্তা দেওয়া হয় তরুণ প্রজন্মকে, ঠিক তার বিপরীত কিছু বোঝাতেই '৭৫-এর হাতিয়ার' টার্মটি চালু করেছিল দেশদ্রোহীরা। ৭১ এর হাতিয়ার বলতে আমরা যেমন বুঝি- আক্রমণকারী পাকিস্তানি জান্তাদের মতো শক্তিশালী যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও বীর বাঙালি বিজয় লাভ করতে পারে, ৭১ এর হাতিয়ার অর্থ অদম্য ও অজেয় বাঙালির স্বরূপ তুলে ধরা। তেমনি ৭৫ এর হাতিয়ার বলতে বোঝানো হয়- ষড়যন্ত্র, খুন, নাশকতা; দেশপ্রমিক সেনাসদস্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মাধ্যমে দেশজুড়ে ত্রাস চালানো, দেশের মানুষকে দাসের মতো জিম্মি করে রাখার স্বরূপই ভেসে ওঠে এই পঙ্কিল শব্দগুলোর শব্দ কানে ভেসে এলে।
১৯৭৫ সাল বাঙালির জাতির ইতিহাসে এক শোকাবহ অধ্যায়। ৭৫ এর অপশক্তিকে আবারো ডাক দিয়ে যে স্লোগান দেয় দুর্বৃত্তরা, তা কোনো জাতির সভ্য সন্তানের কাজ নয়। এটি প্রকৃতপক্ষে কোনো স্লোগান নয়, এই বাক্যগুলো মূলত বর্বর খুনিদের জান্তব হুংকার। এরা দেশদ্রোহী। এই দেশের মাটিতে এদের নিষিদ্ধ করা উচিৎ।