চলমান বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার প্রস্তাব

4572

Published on মে 22, 2022
  • Details Image

মহামারীর ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই নাজুক বিশ্ব অর্থনীতির ওপর ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে নিত্যপণ্যের হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বিপর্যস্ত সরবরাহ ব্যবস্থাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়াসহ চারটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শুক্রবার রাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রথমবারের মতো ‘চ্যাম্পিয়নস গ্রুপ অব গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স ফর ফুড, এনার্জি অ্যান্ড ফাইন্যান্স’ এর বৈঠকে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ প্রস্তাব রাখেন।

এই বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানোয় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে ধন্যবাদ জানিয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই চ্যাম্পিয়ন্স গ্রুপের অংশ হতে পেরে সম্মানিত বোধ করছেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, “ইউক্রেইন যুদ্ধ এমন একটা সময়ে এসেছে যখন পুরো বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারী থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে নাজুক হয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এটা গুরুতর চাপ হয়ে উঠছে।”

বিশ্ববজুড়ে আর্থিক এ সংকট মোকাবেলায় নিজেকে গ্লোবাল সাউথের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি এই সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের কণ্ঠস্বরকে এই টেবিলে পৌঁছে দিচ্ছি।”

তিনি জানান, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে (এসআইডি) সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বইতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তাদের জন্য সহায়তার সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করতে হবে।

সংকট মোকাবেলায় নিজের ভাবনা তুলে ধরে এসময় চারটি প্রস্তাব রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

“প্রথমত, আমাদের বৈশ্বিক সংহতি জোরদার করতে হবে এবং সুসমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জি-৭, জি-২০, ওইসিডি এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরু দায়িত্ব রয়েছে।

“আমি দেখে খুশি হয়েছি যে, এই গ্রুপের স্টিয়ারিং কমিটিতে প্রধান সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। এই সংকট মোকাবেলায় বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো তৈরির জন্য আমরা তাদের পূর্ণ সমর্থন দেব।”

দ্বিতীয় প্রস্তাব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হল বৈশ্বিক লজিস্টিক এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যঘাত মোকাবেলা করা। এটা পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।

“বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং রপ্তানি আয় পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থনও থাকতে হবে, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ এবং অন্যান্য দুর্বল দেশগুলির জন্য।”

এছাড়া উন্নত অর্থনীতি ও বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং শুল্কমুক্ত-কোটা-মুক্ত বাজারে প্রবেশাধিকার এবং আরও সহজলভ্য আর্থিক ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে জানান তিনি।

তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, কার্যকর খাদ্য সঞ্চয় ও বিতরণ ব্যবস্থার জন্য কৃষি খাতের জন্য প্রযুক্তি সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

তিনি বলেন, “নবায়যোগ্য জ্বালানি খাতে, বিশেষ করে এলডিসিগুলোতে (স্বল্পোন্নত দেশ) ব্যবসার ক্ষেত্রে আনকোরা অনেক সুযোগ রয়েছে।”

এই বিষয়গুলো এগিয়ে নিতে বিদ্যমান উত্তর-দক্ষিণ, দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানো যেতে পারে জানিয়ে এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

সবশেষে ৪৮-সদস্যের ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসেবে উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র (এসআইডি) এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলোর জন্য কাজের সুযোগ পাওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেসব দেশে কৃষি-খাদ্য ব্যবস্থা গুরুতর চাপের মধ্যে রয়েছে।”

এসময় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের উদ্যোগ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের জাতীয় উন্নয়ন যাত্রায় উদ্ভাবনী অনেক জলবায়ু কার্যক্রম রয়েছে।

“আমরা অন্যদের সুবিধার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন,জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের জ্ঞান, বোঝাপড়া এবং অভিজ্ঞতা তাদের জানাত চাই।”

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় দৃঢ় বিশ্বাসী। আমরা সব সময় বৈশ্বিক শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি।

“সেই প্রত্যয় থেকেই এ গ্রুপটিকে আমাদের সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি উৎসারিত হয়।”

শেখ হাসিনা বলেন, “জাতি হিসেবে ভয়ঙ্কর সব চ্যালেঞ্জের মুখেও আমাদের সহনশীলতার পরিচয় রয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী তার সর্বশেষ উদাহরণ।”

মহামারী থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের মহামারী পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা জীবন এবং জীবিকা রক্ষার মধ্যে একটি সতর্ক ভারসাম্য দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

“আমরা আমাদের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিদের সামনে রেখেছি। যারা সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে তাদের সহায়তা দিতে আমরা সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রগুলোকে বিস্তৃত করেছি।”

তিনি বলেন, “ভ্যাকসিন কেনার জন্য সময়মত পদক্ষেপ নেওয়ায় বড় একটি স্বাস্থ্য সংকট এড়িয়ে যাওয়া গেছে এবং তাতে জীবন রক্ষা পেয়েছে।”

রপ্তানি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) সহায়তা দিতে বাস্তবসম্মত উদ্যোগের কথা তুলে ধরে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ চালুর কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।

“এসব পদক্ষেপের কারণে গত অর্থবছরে আমাদের ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ জিডিপি অর্জন সম্ভব হয়েছে।”

বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “তবে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিকে অত্যন্ত অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

“সরবরাহের স্বল্পতা এবং খাদ্য, জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে।”

জাতিসংঘ মহাসচিব মহামারী এবং তার পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উদ্যোগগুলো তুলে ধরেন।

তিনি জানান, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃচ্ছ্রতার নীতি নেওয়া হয়েছে।

সামাজিক-নিরাপত্তা-বেষ্টনী কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করে নিয়মিত ১ কোটিরও বেশি মানুষের কাছে খাদ্য এবং নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

কার্ড ইস্যু করার মাধ্যমে প্রান্তিক ১ কোটি মানুষকে ভর্তুকি মূল্যে (৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কম দামে) ভোজ্যতেল, ডাল, চিনির মতো ভোগ্যপণ্য বিক্রি করার কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা জানান, তার সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশীয় খাদ্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করেছে। পণ্য সংগ্রহের জন্য একাধিক উৎস অনুসন্ধান করছে।

এছাড়া কৃষকদের মধ্যে সার বিতরণ করেছে এবং উৎপাদন বাড়াতে ৮৫ শতাংশ মূল্য সহায়তা দিয়েছে।

প্রধামন্ত্রী জানান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে বিলাসবহুল সামগ্রীর আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

এছাড়া অনুমোদিত উপায়ে পাঠানো রেমিটেন্সের জন্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত