1423
Published on মে 21, 2022তন্ময় আহমেদঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব, ১৯৭৫ সালে দেশদ্রোহীদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সময় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার একমাত্র খালা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার মা শেখ রেহানা। এরপর দীর্ঘদিন নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় তাদের। নিত্যদিনের সংকট ও দুর্ভোগকে সঙ্গী করে কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবিত দুই কন্যা ও দৌহিত্রদের কৈশোর-তারুণ্য। ঠিক সেই সময়ের কথা বলছি। ১৯৮০-এর দশকে একজন স্কুলছাত্র ছিলেন রাদওয়ার মুজিব। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের দীর্ঘদিনের সুপরিকল্পিত অপপ্রচারের কারণে তার বন্ধুদের কাছেও তিনি বোঝাতে অনেক অসুবিধায় পড়তেন যে- তার নানা বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সুপারহিরো, যিনি একটি জাতিকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। সেদিনের সেই স্কুলছাত্র রাদওয়ান মুজিবের বয়স এখন ৪২ বছর, কিন্তু এতো বছর পরও সেইসব দুঃসহ দিনের স্মৃতি তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।
পরবর্তীতে তিনি দেখেছেন আইকনিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং মাহাত্মা গান্ধীর জীবনীকে কীভাবে কমিকের মাধ্যমে শিশুদের মানসপটে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাস্তব জীবনের গল্পগুলো শিশুদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিশুদের উপযোগী কমিক তৈরির জন্য অনুপ্রাণিত হন। এর কয়েক দশক পর, মুজিব গ্রাফিক নভেল প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেন। পর্যায়ক্রমে ১০ খণ্ডের কমিক সিরিজ প্রকাশনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর গ্রামীণ বাল্যকাল থেকে শুরু করে জাতির পিতা হিসেবে আবির্ভুত হওয়ার ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয় তার উদ্যোগে। এখন সারা দেশের মানুষ, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এসব কমিক পড়ে জাতির পিতা ও বাঙালি জাতির গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসগুলো সম্পর্কে সহজেই জানতে পারছেন।
জীবনের শুরুতে, তথা ছোটবেলায় মা ও খালার কাছে তার নানা বঙ্গবন্ধুর জীবনের গল্প শুনে বড় হয়েছেন রাদওয়ান মুজিব। তাই তিনি উপলব্ধি করতেন যে, কোন ঘটনাগুলোকে উপস্থাপনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কিংবদন্তিগুলো সবচেয়ে সুন্দরভাবে শিশু-কিশোরদের মানসপটে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেসময় তিনি খুব হতাশ হয়ে পড়েন একারণে যে, তার স্কুলের বন্ধুরাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছুই জানতো না।
এবিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে রাদওয়ান মুজিব বলেছেন, 'আমি ধাক্কা খেয়েছিলাম, কারণ আমি দেখেছি যে আমার স্কুলের অনেক বন্ধুই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তারা জিজ্ঞেস করতো যে, তোমার বঙ্গবন্ধু নানা কে? বিশেষ করে শিক্ষকরাও বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়তেন। এমনকি একদিন একজন শিক্ষক বলেই ফেললেন যে- তোমার নানা বঙ্গবন্ধু (বাংলার মানুষের বন্ধু) ছিলেন না, তিনি ছিলেন বঙ্গশত্রু (বাংলার মানুষের শত্রু)।'
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অস্থির ও অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ তথা মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় প্রতিশ্রুতি থেকে পেছনে ফেরার দিনগুলিতে রীতিমতো পীড়িগ্রস্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ছোট্ট রাদওয়ান মুজিব। ১৯৮০ সালে জন্মের পর প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠার সময় নিজের নানা-নানি ও মামা ও কাছের স্বজনদের ছাড়াই নিঃসঙ্গতার মধ্যে বেড়ে উঠতে হয় তাকে। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দলছুট কিছু সেনা সদস্যের কাছে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয় তাদের। তবে বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কখনো না-দেখা এই প্রিয়জনদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন রাদওয়ার। এ ব্যাপারে তার স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, তিনি বলেন- 'আমি আমার নানি, কামাল মামা এবং রাসেল মামা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। কামাল মামা কী ফুটবল নাকি ক্রিকেট খেলা বেশি পছন্দ করতেন? রাসেল মামার প্রিয় খেলনা কী ছিল?' এসব বিষয় নিয়ে ছোটবেলায় ভাবনার অন্ত ছিল না ছোট্ট রাদওয়ানের।
যদিও বঙ্গবন্ধু আর কখনোই সশরীরে ফিরে আসেননি, তবে তারর লেখাগুলো পড়লেই তার উপস্থিতি উপলব্ধি করা যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর অনেক দিন পর, ২০০৪ সালের কথা, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর লেখা কিছু খাতা (নোটবুক) খুঁজে পান। তরুণ রাদওয়ানের জন্য এটি ছিল একটি আনন্দঘন ঘটনা।
স্মৃতি হাতড়ে এ বিষয়ে তিনি জানান, 'আমি তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) কখনো দেখিনি। কিন্তু তার লেখা তার জীবনের গল্পগুলো তখন আমাদের সাথে। তার লেখাগুলো পড়ে আমাদের মনে হতো আমরা তার সঙ্গে কথা বলছি। বঙ্গবন্ধুর সেইসব খেরোখাতা থেকে যখন দুটি বই প্রকাশ হলো, আমার মাথায় তখন নতুন আইডিয়া এলো। আমার মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে আমরা যদি একটি কমিক সিরিজ প্রকাশ করতে পারি, তাহলে নতুনপ্রজন্মও বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করতে পারবে। কারণ বঙ্গবন্ধুও আমাদের মতো ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন। ছোটবেলায় অন্যান্য শিশু-কিশোরদের মতোই তিনিও খুব খেলাধুলা পছন্দ করতেন। তিনিও তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাতেন। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তরুণপ্রজন্মের আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি গ্রাফিক নভেল সিরিজ তৈরির চিন্তা আসে আমাদের মাথায়।'
রাদওয়ান মুজিব এখন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সিআরআই (সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন) এর একজন ট্রাস্টি। তিনি যখন তার নানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি কমিক সিরিজ প্রকাশের পরিকল্পনা করেন, তখন অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্তরাও বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মর্যাদাবান ব্যক্তির জীবনের গল্পগুলোকে কার্টুনের আকারে দেখতে চাননি। তবে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ তনয়া শেখ রেহানার সমর্থন ও উৎসাহের কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমর্থ হন রাদওয়ান।
মুজিব গ্রাফিক নভেল সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি তাই বলেন, 'আমরা ভাগ্যবাদ যে, আমার মা (শেখ রেহানা) ও আমার খালা ( প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) শুরু থেকেই এই পরিকল্পনাটিকে সমর্থন করেছেন। তাদের ছাড়া আমরা এটি বাস্তবায়ন করতে পারতাম না। আমি নিয়মিত এই গ্রাফিক নভেলের স্ক্রিপ্ট এবং কার্টুনের খসড়াগুলো আমার মা এবং খালাকে দিতাম। আপনারা জানেন, আমার খালা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কতো ব্যস্ত। আমি এই কমিকের খসড়াগুলো নিয়মিত তার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার) টেবিলে রেখে আসতাম, যাতে অফিস থেকে ফেরার পর তিনি সেগুলো চেক করে দেখতে পারেন। আমি অবাক হয়ে যেতাম এটা দেখে যে, তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) অফিস থেকে ফেরার এক বা দুই ঘণ্টা পরেই খসড়াগুলোর ওপর নিজের পর্যবেক্ষণ লিখতেন তিনি। কখনো কখনো আমার টিমের সদস্যরা অবাক হয়ে যেতো, এমনকি তারা আমার কাছে জানতেও চাইতো যে- পর্যবেক্ষণগুলো প্রধানমন্ত্রী নিজেই লিখেছেন কিনা!'
সিআরআই থেকে প্রকাশিত মুজিব গ্রাফিক নভেল ছাড়াও, জাতির ইতিহাসকে তারুণ্যের কাছাকাছি আনতে আরো কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন রাদওয়ান মুজিব। মুজিব গ্রাফিক নভেল যেমন তার ব্রেনচাইল্ড, তেমনি জয় বাংলা কনসার্ট চালু করার পরিকল্পনাটিও তার, যে কনসার্টের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাসকে আধুনিক সুর ও সংগীতের মাধ্যমে নতুনপ্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয়। এমনকি 'হাসিনা: অ্যা ডটারস টেল' নামের ডকুড্রামাটির একজন প্রযোজকও তিনি, এই ডকুড্রামার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কণ্ঠে তার বাবা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পুরো পরিবারকে হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ের তাদের জীবনযন্ত্রণার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।
লেখকঃ কোঅর্ডিনেটর, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন