932
Published on মে 17, 2022এম. নজরুল ইসলামঃ
গ্রিক পুরাণের বীর চরিত্র প্রমিথিউস দেবতাদের কাছ থেকে আগুন উদ্ধার করে এনেছিলেন। তাঁকে প্রযুক্তি, জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। তিনি সভ্যতা ও মানবতার প্রতিক। প্রমিথিউস তাঁর বুদ্ধিমত্তার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
গ্রিক পুরাণের গল্পটি আগে জানা যাক। অনেকদিন আগের কথা। অলিম্পাসের চ‚ড়ায় জিউসসহ যেসব দেবতার বাস ছিল, তাঁদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল টাইটানরা। কিন্তু দেবতাদের মতো অত ক্ষমতা না থাকায় যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হতে হয়েছিল তাদের। পরাজিত টাইটানদের বন্দি করা হয়েছিল এমন এক জায়গাতে, যেন তারা আর ফিরে আসতে না পারে।
প্রমিথিউস ছিলেন এরকম এক টাইটানের ছেলে। প্রমিথিউস আর তাঁর ভাই এপিমিথিউসকে বন্দি না করে জিউস তাঁর সঙ্গেই রেখেছিল। কিন্তু প্রমিথিউসের কোনো ইচ্ছে ছিল না অলিম্পাসে থাকার। তিনি তাঁর ভাইকে নিয়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন।
একদিন প্রমিথিউস কাদা নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় কী মনে করে যেন দেবতাদের আদলে মানুষ বানিয়ে ফেললেন। বানানোর সময় অন্যান্য যত পশু-পাখি ছিল তার কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে দিলেন। কিন্তু মানুষ সুখে ছিল না। অন্যান্য পশুদের ভয়ে তারা রাতের বেলায় গুহায় পালিয়ে থাকতো, কাঁচা মাংস খেত, ঠাণ্ডায় আর শীতে কাঁপত। মানুষের এরকম জীবন যাপন দেখে প্রমিথিউসের মন খারাপ হল। তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, মানুষের কাছে যদি আগুন থাকতো তাহলে তো এরকম করে জীবন কাটাতে হতো না।
অনেক চিন্তা করে প্রমিথিউস জিউসের কাছে গিয়ে মানুষের জন্য আগুন চাইলেন। কিন্তু জিউস ¯্রফে না করে দিলেন। কারণ দেখালেন যে, আগুন পেলে মানুষ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং এক সময় তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে দাঁড়াবে। এই শুনে প্রমিথিউস দুঃখ পেলেও আর কিছু না বলে চলে এলেন। কিন্তু মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষকে তিনি আগুন এনে দেবেনই।
এই ভেবে প্রমিথিউস একদিন রওনা হল পূর্ব দিকে, যেদিক দিয়ে সূর্য ওঠে। পূর্ব দিকের সর্বশেষ প্রান্তে পৌঁছে তিনি দেখলেন যে, সূর্য তার সারাদিনের পথ পরিক্রমার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তখনো পুরো তেজ নিয়ে জ্বলা শুরু করেনি। সুযোগ বুঝে প্রমিথিউস সূর্যের এক কোণা ভেঙে নিয়ে চলে এলেন।
মানুষের কাছে এসে তিনি মানুষকে আগুন ধরিয়ে দেখালেন, আগুন কিভাবে জ্বালতে হয় , কিভাবে আগুন দিয়ে রান্না করে খেতে হয়, তা শেখালেন। এর পাশাপাশি চাষাবাদ, হাতিয়ার তৈরি থেকে আরো অনেক কিছু শিখিয়ে দিলেন। মানুষ স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার গুহা ছেড়ে বাইরে থাকা শুরু করল, ঘর-বাড়ি বানানো শিখল। মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াল।
এই গল্পেরই পুনরাবৃত্তি যেন আমরা দেখতে পাই ১৯৮১ সালের ১৭ মে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে এদেশের একদল মানুষ যেন নিজেদের দেবতার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। যা কিছু ভালো, সব তাদের অবদান, এটাই ছিল একমাত্র প্রচার। গণতন্ত্রের আকাশ ঢেকে দেওয়া হয়েছিল সামরিকতন্ত্রের কালো মেঘ দিয়ে। সমাজের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেশ ও জাতিকে গ্রাস করেছিল একরাশ অন্ধকার। সে এক অবরুদ্ধ অবস্থা। সপরিবারে নিহত জাতির পিতা। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই। সেই দিকভ্রান্ত দিনে এক আলোকবর্তিকা নিয়ে তিনি পা রাখলেন সেই মাটিতে, যেখানে মিশে আছে তাঁর স্বজনের রক্ত। সেই দিনটি হচ্ছে ১৭ মে, ১৯৮১।
সেদিন ঢাকার সব পথ মিশে গিয়েছিল বিমানবন্দর ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। আসলে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইছিল মানুষ। তারা বুঝেছিল, তাদের ত্রাতা আসছেন। আসছেন সেই দিক-নির্দেশক, যিনি মুক্তির অগ্রযাত্রায় আসন্ন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন। মানুষের অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলনে নতুন গতি যে তাঁরই যোগ্য নেতৃত্বে নতুন করে সূচিত হবে, তা বুঝতে এ দেশের মানুষের একটুও সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুর মতো উদারপ্রাণ, মহৎ মানুষকে হারিয়ে এদেশের মানুষ তখন এমন কাউকে খুঁজছে, যার ওপর শতভাগ নির্ভর করা যায়। মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবেই জননেত্রী শেখ হাসিনার ফিরে আসা বাংলা মাটিতে।
দেবতাদের মত ক্ষমতা না থাকলেও, প্রমিথিউসের ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা ছিল। পরদিন বা পরের সপ্তাহ, বা পরের মাস, এমনকি কয়েকশো বছর পরের ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা তাঁর ছিল। শেখ হাসিনাও এক সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখতে পান, দেখতে চান। রূপকল্প ২০২১ ছিল ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী ইশতেহার। এটি দেশের বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরের জন্য বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে ওঠে। রূপকল্প ২০৪১ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ভিশন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে গড়ে তোলার জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা। নেদারল্যান্ডসের আদলে গ্রহণ করা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসাবে কাজ করবে। শতবর্ষের এ মহাপরিকল্পনার প্রথম ধাপ ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রমিথিউসের ওপর অত্যাচার কম হয়নি। জিউস অলিম্পাস পর্বত থেকে মানুষের এ অগ্রযাত্রা প্রত্যক্ষ করলেন। তাঁর আর বুঝতে বাকি রইলো না এসবের পেছনে কার হাত রয়েছে! জিউসের রাগটা গিয়ে পড়লো শুধুই প্রমিথিউসের উপর। প্রচণ্ড ক্রোধের বশে জিউস প্রমিথিউসকে ককেশাসের এক খাড়া পর্বতের গায়ে অনন্তকালের জন্য শৃঙ্খলিত করে রাখার নির্দেশ দিলেন। প্রতিদিন সকালে শেকলবদ্ধ প্রমিথিউসের কাছে একটি ঈগল আসতো। ঈগলটি প্রমিথিউসের কলিজা ঠুকরে ঠুকরে খেত সারাদিন। রাতে আবার প্রমিথিউসের শরীরে নতুন কলিজা প্রতিস্থাপন করা হতো, পরদিন ঈগলটি যাতে আবার এসে খেতে পারে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে তারিখের পর এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বারবার শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। তাঁকে অন্তরীণ করা হয়েছে। হত্যার জন্য কমপক্ষে ১৯ বার সশস্ত্র হামলা হয়েছে তার ওপর।
সব চক্রান্তের জাল একে একে ছিন্ন করেছেন তিনি। বাঙালিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্রত সাধনা থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে এই দেশে। কার্যকর হয়েছে দণ্ড। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হয়েছে। এরই মধ্যে পাঁচ যুদ্ধাপরাধীর দÐ কার্যকর হয়েছে। ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে সমাধান হয়েছে। বাস্তবায়িত হয়েছে সীমানা চুক্তি। বিনিময় হয়েছে ছিটমহল। দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, আন্তর্জাতিক আদালতে তার সমাধান হয়েছে।
প্রমিথিউস প্রকৃতির শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের অগ্রগতির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দিয়েছেন আগুন এবং আশার উপহার। আশা মানুষকে একটি উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করতে সাহায্য করে। আগুন প্রযুক্তির উৎস হিসাবে সেই সংগ্রামে সাফল্যকে সম্ভব করে তোলে। বাংলাদেশ যে আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, তার শতভাগ কৃতিত্ব শেখ হাসিনার। তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব আজ বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করেছে। জনকল্যাণের ব্রত সাধনার মন্ত্রে নতুন দীক্ষা নিয়ে আজকের এই দিনে এক নিঃস্ব নারী পিতৃভূমিতে পা রেখেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তিনি একেবারেই একা নন। বাংলার মানুষ রয়েছে তাঁর পাশে। এরাই তাঁর আত্মার আত্মীয়। হার্দিক উষ্ণতায় মানুষ তাকে বরণ করে নিয়েছিল। নিজেকে উজাড় করে একরাশ বৃষ্টির মধ্যে তিনিও ভেসে গিয়েছিলেন আবেগের অশ্রুতে।
প্রমিথিউসের আগুন মানুষকে দিয়েছিল শক্তি। দ্রুত বিকাশ ঘটেছিল মানব সভ্যতার। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে এদেশের মানুষ পেয়েছিল ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। তাঁর ফিরে আসা গণতন্ত্রকামী মানুষকে জুগিয়েছিল শক্তি। আজও তিনি মানুষের মুক্তির প্রতীক। টানা তৃতীয়বারের মতো সরকারের প্রধান তিনি। সব অপশাসনের মূলোৎপাটন করে যিনি বাংলাদেশকে আজ নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। আজকের বাংলাদেশকে নিয়ে তাই উচ্ছ্বসিত সারা বিশ্ব। একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশকে নিয়ে সংশয় ছিল সারা বিশ্বের। সেই অবস্থা থেকে আজকের উত্তরণে যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি শেখ হাসিনা। তার সাহসী নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হয়েছে। নেতিবাচক অবস্থান থেকে বিশ্বে ইতিবাচক দেশ হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ আজকের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় শেখ হাসিনার অবদান অনস্বীকার্য। এই অর্জন ধরে রাখতে ও উন্নত দেশ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে তার গতিশীল নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই।
আজকের এই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করি। স্মরণ করি সেই বর্ষণমুখর দিন, যেদিন তিনি ফিরেছিলেন বাংলাদেশে, মানুষের কল্যাণব্রত সাধনার নতুন মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে। নতুন করে জেগে ওঠা বাংলাদেশের প্রতীক শেখ হাসিনা।
লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক