অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

912

Published on মে 16, 2022
  • Details Image

এস. এম. রাকিবুল হাসানঃ 

প্রগতিশীল সমাজের একটা বড় অংশই যখন ক্ষমতার লোভে সামরিক শাসক জিয়ার সহযোগী হয়ে সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে শুরু করেছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যখন বাংলাদেশের রাজনীতি ধীরে ধীরে দক্ষিণপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছিলো; তখন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশ ও জনগনের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দলের দায়িত্ব প্রদানের দাবী ওঠে দেশের সর্বস্তরে। সে পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কাছে শতভাগ আস্থাশীল নেতৃত্বের যে সংকট দেখা দিয়েছিল তার সময়োপযোগী ও অবিকল্প সমাধান ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। নেতা-কর্মীদের আশা আকাঙ্খা এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ঘোর অমানিশার অন্ধকার দূর করার মহৎ উদ্দেশ্যে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫, ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং বিশ্বস্ত নেতৃত্বের অনেকেই দিল্লী গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করে তাঁকে দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার পবিত্র দায়িত্ব গ্রহনের জন্য রাজি করাতে সমর্থ হন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ সেলিম, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, ডা. এসএ মালেক এবং দলীয় নেতাদের মধ্যে জিল্লুর রহমান, আইভি রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, আবদুর রাজ্জাক, সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে দিল্লী গিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার খোঁজ-খবর নেন এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বকে ভয় পেয়ে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে না দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেশে প্রত্যাবর্তনসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে দিল্লী যান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ আজাদ, জোহরা তাজউদ্দীন, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আইভি রহমান প্রমুখ। পূর্ব থেকেই ছিলেন ডাঃ এসএ মালেক। এ সময় দিল্লীতে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সাজেদা চৌধুরীসহ দু'জন কে রেখে বাকিরা সবাই দেশে ফিরে আসেন। তাদের দুজনের ওপর দায়িত্ব ছিল শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা। ঠিক হলো ১৭ কিংবা ২৬ মার্চ শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা এবং কন্যা পুতুলের জলবসন্ত দেখা দেয়ায় বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিলম্বিত হয়।

অবশেষে ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর নির্ধারিত হয় ১৭ মে ১৯৮১ শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে আসবেন। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে দিল্লী যান আবদুস সামাদ আজাদ সহ আরও কয়েকজন । ১৬ মে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে দিল্লী থেকে কলকাতা এলেন শেখ হাসিনা, কন্যা পুতুল এবং আবদুস সামাদ আজাদ সহ বাকিরা।

অবশেষে এল সেই আবেগঘন ঐতিহাসিক ১৭ ই মে, ১৯৮১। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ, ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন শোকের চাদর গায়ে মলিন বদনে শেখ হাসিনার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। বিকেল সাড়ে চারটায় তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে নামেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসন শেষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরলেন বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে। বিমান থেকে নামার পর শুরু হওয়া অঝোর ধারার বৃষ্টি যেন শেখ হাসিনার অশ্রুজল হয়ে ভরিয়ে দিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুপ্রেমির স্লোগানের মাঝে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চৌষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিটি লোকালয়ে। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।”

দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধুহত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর শেখ হাসিনার শুরু হলো এক নতুন জীবন, নতুন সংগ্রাম। পরিবারহীন শেখ হাসিনার সে সংগ্রামে ঢাকার যে কয়েকটি পরিবার নিভৃতে সঙ্গ দিয়ে গেছে অবিরত তন্মধ্যে ফজলুর রহমান রাজু'র পরিবার, হাফেজ মুসা'র পরিবার, পিয়ারু সরদারের পরিবার অন্যতম। বঙ্গবন্ধুকন্যার সে সংগ্রাম ছিল কারাগারে বন্দী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও মিথ্যা মামলা আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো কর্মীদের আগলে রেখে পথ দেখানোর সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা শক্ত হাতে রুখে দেয়ার সংগ্রাম। ভয়ভীতি প্রদর্শন আর অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙা, নেতাকর্মীদের ক্ষমতাসীন দলে ভেড়ানোর চেষ্টা এবং কখনও কখনও দলীয় কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করার দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়ার সংগ্রাম। একই সঙ্গে সারাদেশে দলকে পুনর্জীবিত করে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামও শুরু করেন। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের ফলে যে সমস্ত অবৈধ নির্দেশ ও কালোকানুন জারি করে পরবর্তীতে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তা বাতিল এবং পরিবর্তনের দাবি জানান শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধানের চার মূলনীতি পুন:স্থাপনের দাবিও উত্থাপন করেন তিনি। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী এবং জেলহত্যাকারীদের বিচার করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্তি, চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগদানের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান তিনি।

ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। এর পরের সংগ্রাম ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন আজীবন লালন করে গেছেন ; তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে তার সেই স্বপ্নের বীজ আজ মহীরুহে পরিনত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বাংলাদেশের আজকের এই উত্তরণের রুপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সাহসী অভিযাত্রায় সংযুক্ত হয়েছে দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সফল উৎক্ষেপণ, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত, সমুদ্র বিজয়, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানীমূখী শিল্পায়ন, ১০০ টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, রপ্তানী আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ ও ‘উন্নয়নের নিরীক্ষা ক্ষেত্র’ আখ্যা দেয়া তাত্ত্বিকেরাও আজ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের উন্নয়নচিত্র দেখে শেখ হাসিনার গুনমুগ্ধ। করোনায় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এবং খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ; যা শেখ হাসিনার অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশলের বাস্তব চিত্র।

সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কারণেই আজ আমরা পেয়েছি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, শতভাগ বিদ্যুতায়িত , ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল অর্থনীতির বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যখনই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তখনই এদেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে বাস্তবায়ন করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগ। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম এবং নিখাঁদ ভালোবাসাই হলো তার রাজনৈতিক শক্তি।

লেখকঃ  শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত