3005
Published on মার্চ 20, 2022বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে দাসত্ব থেকে মুক্তির কথা দিয়েছিলেন, তাই স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। পরবর্তীতে সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসনের কারণে অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল এই দেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দেশকে অন্ধকার থেকে উত্তরণ ঘটিয়ৈ আবারও উন্নতির পথে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন। এজন্য ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি দিন বদলের ইশতেহার ঘোষণা করেন। সেখানে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনাকে বদলে দেওয়ার রোডম্যাপ দেওয়া হয়। নিরলস পরিশ্রম করে গত একযুগে তা বাস্তবায়ন করেছে সরকার।
প্রতিটি গ্রামে যান, দেখবেন আলো। দেখবেন বিদ্যুতের সুফল কাজে লাগিয়ে আধুনিক চাষাবাদ, খামার ও ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। অথচ মাত্র একযুগ আগে, বড় বড় শহরগুলো পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ডুবে থাকতো। হ্যাঁ, বিদ্যুৎ খাতের আমূল পরিবর্তনের কারণেই আজ ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে 'তলাবিহিন ঝুড়ির' বাংলাদেশ।
যতো উন্নয়ন হয়েছে গত একযুগে, তারমধ্যে সবচেয়ে বড় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে বিদ্যুৎ খাত। ফলে জিডিটাইজড বাংলাদেশ এখন বিদেশি বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করছে নতুন করে। বিদ্যুতে ভর করেই বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। স্বারলম্বী হয়ে উঠেছে সর্বোস্তরের মানুষ।
কী ছিল ২০০৮ সালের ইশতেহারে:
আসুন দেখে আসি, ২০০৮ সালের ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কী বলেছিল। জনগণের কাছে দলটি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিল, 'বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সার্বিক জ্বালানি নীতিমালা গ্রহণ করা হবে। তেল, গ্যাস, কয়লা, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস ও জৈবশক্তি, বায়ুশক্তি ও সৌর শক্তিসহ জ্বালানির প্রতিটি উৎস নিশ্চিত করা হবে। আঞ্চলিক জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। তিন বছর মেয়াদী ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় বর্তমানে নির্মাধীন ও গৃহীত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দ্রুত বাস্তবায়ন, জরুরি ভিত্তিতে ১০০-১৫০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন প্রকল্প, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেসরকারী খাতে ১০,২০ ও ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রসহ বৃহৎ ও ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ওভারহোলিংয়ের ব্যবস্থা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী তিন বছরে অর্থাৎ ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে, ২০১৩ সালের মধ্যে ৭ হাজার মেগাওয়াটে এবং ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষে উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।'
একযুগে অর্জন কতটুকু:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একযুগ আগে যে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রায় সবগুলোই পূরণ হয়েছে এবং সাধারণ মানুষ তার সুফলও পাচ্ছে। ২০০৯ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যখন দায়িত্ব নেন, তখনও দেশের মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। নিয়মিত লোডশেডিংয়ে তখন জনজীবন বির্যস্ত ছিল। বিদ্যুৎ খাতের এই করুণ অবস্থার কারণে বৃহৎ শিল্পগুলো যেমন একদিকে ধুঁকছিল, তেমনিভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না।
কিন্তু গত এক যুগে সেই পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে। এখন দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। আর বিদ্যুৎ খাতের এই পরিবর্তনের ফলে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড মজবুত হতে শুরু করেছে। সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎখাতের সাফল্য ছোট-বড়-মাঝারি শিল্পে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। বিদ্যুতায়নের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক উন্নতির কারণেই বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআইডিএস) এর এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে- বাংলাদেশে প্রতি মিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে উাৎপাদন বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪৬ মিলিয়ন টাকা হতে ১০৭ মিলিয়ন টাকা (১৯৯৫/৯৬ এর মূল্যকে স্থির ধরে)। উক্ত গবেষণা মতে, ২০১১-১২ অর্থবছরে জিডিপিতে কুইক রেন্টালের মাধ্যমে উৎপাদিত অতিরিক্ত বিদ্যুতের অবদান প্রায় ২৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকা হতে ১ লাখ ২১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা (২০১১-১২ অর্থবছরের মূল্য বিবেচনায়)। সেই মোতাবেক বিগত ৯ বছরে (২০০৮-০৯ হতে ২০১৬-১৭) মোট ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯৮২ মিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা, যা জাতীয় জিডিপি’র প্রায় ২২ শতাংশ।
যেভাবে বিদ্যুতের কারণে বদলে গেছে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন:
বিদ্যুতের সুবিধা কীভাবে দুর্গম গ্রামের মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে, তা বুঝতে হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার এক যুগ আগের এবং এখনকার অবস্থার মধ্যকার পার্থক্য পর্যালোচনা করতে হবে। আমরা নাটোরের চলনবিল এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সরেজমিনে ঘুরে এসে সেরকম তিনটি কেস স্টাডি উপস্থাপন করছি।
যেহেতু বিল এলাকা, সুতরাং সারা দেশের বিলাঞ্চলের মতো এখানকার যোগযোগ ব্যবস্থাও দেশের অন্য জায়গার তুলনায় বেশ নাজুক। তারপরও সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে কৃষি, স্বাস্থ্য এবং নতুন নতুন উদ্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চার করেছে।
গ্রাম্য ডাক্তার সরকার আতাউর রহমান। যার বাড়ি একেবারেই বিলের মধ্যে। বর্ষা মৌসুমে তার বাড়ি পুরোটাই পানি দিয়ে ঘেরা থাকে। আর শুষ্ক মৌসুমে বিরান মাঠ। শুধু জীবিত মানুষের পোস্টারের মতোই বেঁচে ছিলেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি জীবন অর্থবহ হয়ে উঠেছে তার কাছে। এক বিদ্যুতের উপস্থিতিই বদলে দিয়েছে তার জীবন।
দুর্গম বিলের মধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে তার কী ধরনের উপকার হয়েছে জানতে চাওয়া হলে আতাউর রহমান বলেন, 'জীবনে গতি এসেছে। জীবনমানও অনেক উন্নত হয়েছে। হ্যারিকেনের আলোর বদলে বিজলি-বাতিতে এলাকার চারপাশ আলোকিত হয়েছে।'
গ্রাম্য ডাক্তার হওয়ার কারণে রাত-বিরাতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় এই আতাউর রহমানকে। অন্ধকার সময়ের থেকে এখন রোগী দেখতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তিনি। আগে অন্ধকারের কারণে অনেকসময় মুমূর্ষু রোগীর খবর পেলেও, হয়তো যাওয়া সম্ভব হতো না। তবে এখন বৈদ্যুতিক আলোয় আসায় যেকোনো সময় রোগী দেখতে পারেন। এছাড়াও বিদ্যুতের সুবিধা ব্যবহার করে নিজের জায়গা-জমিতে কৃষিকাজও করেন। ডিজেলচালিত সেচ পাম্প দিয়ে কৃষি আবাদ করতে প্রতি মৌসুমেই তাকে আগে গুণতে হতো প্রায় ৭০-৮০ হাজার অতিরিক্ত টাকা। বিদ্যুৎ আসার ফলে বৈদ্যুতিক সেচ পাম্পে তার খরচ হয় এক কৃৃষি মৌসুমে ৫ হাজার টাকার মতো। সেকারণে কৃষিজ উৎপাদন থেকে এখন অধিক লাভবান হচ্ছেন বরেও জানান আতাউর রহমান।
নাটোরের চলনবিলের সাত পকুরিয়া এলাকার বাসিন্দা রিপন হোসেন। একসময় কর্মের জন্য তাকে যেতে হতো বাড়ি থেকে অনেকদূরে, শহরাস্তিতে অন্যের দোকানে লেদ মেশিনের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু চলনবিলের মধ্য দিয়েই আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে তার এলাকাতেও। তাই গ্রাম থেকে শহরাস্তিতে গিয়ে অন্যের দোকানে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন নিজ গ্রামের বাজারে নিজেই একটা লেদ মেশিনের দোকান দিয়েছেন রিপন। মধ্যরাত পর্যন্ত দুই শিফটে কাজ করেন। ফলে একদিকে যেমন সময় বাঁচছে, তেমনি আয়ও বেড়েছে তার। এখন রিপন হোসেন তার বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে পারছেন নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে।
চলনবিল এলাকার আরো একজন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তার নাম দৌলত হোসেন। একসময় চাকরির জন্য স্ট্রাগল করেছেন। তবে নাটোরের চলনবিল এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ার পর নিজের মিশন বদলে ফেলেন তিনি। স্বাধীন পেশা হিসেবে ফার্মিং শুরু করেন। ফলে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পেরেছেন। তার পোল্ট্রি খামারে এখন প্রায় ৫০ হাজার মুরগি রয়েছে এবং প্রতি মাসে নিচের হ্যাচারি থেকে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মুরগির বাচ্চা ফোটান তিনি। দৌলত হোসেনের এই অসম্ভব ভালো উদ্যোগ শুরুই হতো না, যদি না এই এলাকায় বিদ্যুৎ আসতো। সারা দেশে এমন অসংখ্য নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করেছে সরকারের শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রকল্প।
এছাড়াও সামগ্রিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনার ওপরও খুবই ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে শতভাগ বিদ্যুতায়নের। গ্রামের অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীরা আগে সন্ধ্যার পর লেখাপড়া বন্ধ করে দিতো, আর স্বচ্ছলরাও কেরোসিন পুড়িয়ে প্রথম রাতের কিছু সময় রেখাপড়া করতে পারতো। কিন্তু সুলভমূল্যে বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়ার ফলে, এখন সামাজিক বৈষম্য কমে গেছে। নিম্ন আয়ের মানুষরাও তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারছেন। এবং প্রতি বছরই এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত এসে ভর্তি হচ্ছে।
এমনকি গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের ফলে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সেবার হার বেড়েছে, শিশুমৃত্যু ও প্রসূতি মৃত্যুর হারও কমে এসেছে অর্ধেকের বেশি। পুষ্টিহীনতার হার কমছে. বেড়ে উঠছে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও বলিষ্ঠ নতুন প্রজন্ম।
দৌলত হোসেনের মতো দেশের প্রতিটি গ্রামেই আজ পোল্ট্রি এবং মৎস্য খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। ক্ষুধা-মন্দার সময় পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। এভাবেই ঘরে ঘরে সৃষ্টি হচ্ছে ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মসংস্থান। ফলে সচ্ছলতা বাড়ছে মানুষের। প্রধানমন্ত্রী যেসব অবকাঠামো সৃষ্টি করছেন, সেসবের সুবিধা নিয়েই ভাগ্য বদলাচ্ছেন দেশের জনতা, ফলে বদলে যাচ্ছে দেশ।