ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে কোথায় আছে বাংলা

967

Published on মার্চ 16, 2022
  • Details Image

সাদিকুর রহমান পরাগ: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি। সেই সঙ্গে আমরা পালন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। জাতীয় জীবনের এই দুই আনন্দঘন উপলক্ষের মধ্যে পূর্ণ হলো ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর। যেখানে আমার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চাওয়া হয়েছিল, সেখানে সেই অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে আমরা পেরিয়ে এসেছি ৭০টি বছর। এটিও আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি বিষয়।

৭০ বছরে দাঁড়িয়ে একটি আত্মবিশ্লেষণ তো হতেই পারে- কোথায় আছে বাংলা, ভাষা এবং দেশ দুটোই। সে-হিসাবটি মিলিয়ে নেওয়ার আগে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন কী ছিল সেটিও আমরা একটু জেনে নিই। ১৯৭১ সালের ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সমাজ কর্তৃক প্রদত্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “ ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন ছিল না, এই আন্দোলন ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন।”

ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর এই যে উপলব্ধি সেটি নিশ্চয়ই ব্যাখ্যার আর অবকাশ রাখে না। চলুন এবার দেখে নিই, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে কোথায় আছে বাংলা।

আত্ম-অধিকারের প্রথম পাঠ

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস এবং ব্রিটিশের কূটকৌশলে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায়। দ্বিজাতির ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এই রাষ্ট্রকাঠামোয় বাঙালি জাতির মুক্তি নাই। তার এই ধারণা সত্য প্রমাণিত হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। পাকিস্তানি শাষকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠীর (জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ) ওপর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু সেদিন বাঙালি সেটি মেনে নেয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ উপলক্ষে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। এটিই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে আমাদের আত্ম-অধিকারের প্রথম পাঠ।

স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন

ভাষার প্রশ্নে বাঙালি জাতির প্রথম মোহভঙ্গ ঘটে। বাঙালির এই জাগরণ শুধুমাত্র ভাষার দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, তারপর স্বাধীনতার সংগ্রাম। তাই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বীজ বপিত হয়েছিল। ভাষাকে ঘিরে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, স্বপ্ন দেখেছি, সংগ্রাম করেছি, অন্যায়ের সাথে আপস না করার শপথ নিয়েছি। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দমন-পীড়ন-জেল-জুলুম সবকিছু মোকাবিলা করে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করেন স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পূর্ণতা পায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে।

শহিদ মিনার

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে নেমে আসে ছাত্ররা। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে মারা যান বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি সেই মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শহিদ রিকশাচালক আওয়ালের ছয় বছরের মেয়ে বসিরন।

আজকে সারাদেশে, বিশেষ করে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, নির্মাণ করা হয়েছে শহিদ মিনার। এই শহিদ মিনার আজ বাঙালির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনার প্রাণকেন্দ্র। এই শহিদ মিনার আমাদের আত্ম-পরিচয়, আমাদের আত্ম-উপলব্ধির তীর্থস্থান। এই শহিদ মিনার আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দৃপ্তশপথ। এই শহিদ মিনার আজ প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের পাঠ।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

বিশ্বজুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এই দিবস ঘোষিত হওয়ায় নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। এই ঘোষণার মাধ্যমে সারাবিশ্বের মানুষের মাতৃভাষার অধিকার স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রয়াত দুই প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ঘোষণার ব্যাপারে প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র এগিয়ে না এলে সেটি সম্ভব নয় বিধায় বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন এই উদ্যোগকে বাস্তবরূপ দিতে। তার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

বাংলা একাডেমি

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন নতুন গবেষণা, প্রকাশনাসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ বাংলা একাডেমি নিরন্তর করে চলেছে। ভাষা চলমান, নদীর মতো প্রবাহমান। সাম্প্রতিককালে ‘বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’, ‘বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা’, ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’, ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’র মতো প্রকাশনা একে আরও সমৃদ্ধ করেছে; এছাড়া বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞানের নানান শাখায় সমৃদ্ধ গ্রন্থসমূহ নিয়মিতভাবে অনুবাদ ও প্রকাশ করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

অমর একুশে বইমেলা

একুশ ফেব্রুয়ারি আর বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা এতটাই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত যে এ দুটি বিষয়কে আমরা আলাদাভাবে চিন্তা তো দূরের কথা, কল্পনাও করতে পারি না। এই বইমেলা আমাদের সমাজজীবনকে একটি পূর্ণতা দিয়েছে। এটি আর এখন নিছক বইমেলা নেই, এটি পরিণত হয়েছে বাঙালির প্রাণের মিলন মেলায়। সারাবছর লেখক-প্রকাশক-পাঠকরা অপেক্ষায় থাকেন এই মেলার জন্য। আজ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক প্রকাশ ঘটে। বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন নতুন বই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রার চালচিত্রই শুধু পরিস্ফুট করে না; বরং এর মধ্য দিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতেও সৃষ্টি হয় ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বটতলায় ৩২টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করা ক্ষুদ্র পরিসরের সেই মেলাটির ব্যাপ্তি এতটাই বেড়েছে যে এটি আজ বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমিতে আয়োজন করা হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্য সম্মেলন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমিতে একাধিকবার আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন আয়োজিত হয়েছে। ২০১৫ সালে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় চার দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন-২০১৫’। ২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’- গুরুসদয় দত্তের এই মহান বাণীকে উপজীব্য করে দেশি-বিদেশি বাঙালি সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন’। একই বছর ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্বের ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন। এই সম্মেলনগুলোতে দেশি-বিদেশি সাহিত্যিক, গবেষক ও মননবিশ্বের প্রতিভূ ব্যক্তিবর্গ বাংলা একাডেমিতে এসেছেন, এদেশের শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দৃষ্টিভঙ্গির আদান-প্রদানের এ ধরনের আয়োজন আমাদের জানার পরিধিকে আরও ঋদ্ধ করেছে, প্রাণিত করেছে। এটি একদিকে নতুন সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করেছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের সামর্থ্যকে তুলে ধরতে সহায়তা করেছে।

প্রকাশনা শিল্প

ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আমাদের আজকের প্রকাশনা শিল্প। বাংলাদেশে বই প্রকাশ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৪ হাজার প্রকাশক ও ব্যবসায়ী। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে এই শিল্পটি বিকশিত হতো না। সারাবছর ধরে বই প্রকাশিত হলেও আমাদের প্রকাশনা শিল্প মূলত আবর্তিত হয় অমর একুশে বইমেলাকে ঘিরে, যেটি বিশ্বে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। অমর একুশে বইমেলা-২০২২-এ মোট ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করছে।

একুশে পদক

যে জাতি গুণের কদর করে না কিংবা গুণীজনদের সম্মান দেয় না বা দিতে জানে না, সেই জাতি কখনও নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারে না। ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রবর্তন করা হয় অন্যতম সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকÑ একুশে পদক। স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গুণী মানুষদের সম্মাননা দিতেই এই পদক।

কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, অতীতে অগণতান্ত্রিক সরকারের সময় যথাযথ ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করা হয়নি। প্রকৃত গুণী মানুষরা ছিলেন অবহেলিত, উপেক্ষিত। সংকীর্ণ দলীয় বিবেচনায় এই পদক প্রদান করা হয়। তবে এটি মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কেননা, যারা ভাষা, স্বাধীনতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবকিছুই ধ্বংস করতে সক্রিয়, এদেশের প্রতি যাদের মমত্ববোধ নেই, তাদের কাছে গুণীর কদর হবে না- এটাই তো স্বাভাবিক।
তবে আশার কথা হচ্ছে, দীর্ঘদিনের এই অশ্রদ্ধার সংস্কৃতি থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বেরিয়ে এসেছি। বিভিন্ন অঙ্গনের গুণী ও যোগ্য মানুষদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং সম্মান প্রদান করা হচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলা ভাষা

ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশের ফলে আমাদের জীবনযাত্রা একদিকে সহজ হয়েছে, অন্যদিকে জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে। বিভিন্ন পরিষেবা এখন আমাদের হাতের নাগালেই। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ছিল সীমিত। তবে এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। বিজয়, মুনীর, অভ্র, ইউনি-বিজয় বিভিন্ন ধরনের কী-বোর্ড ব্যবহার করে ইন্টারনেট এবং ওয়েবে এখন বাংলা ব্যবহার করা যায়। বাংলা ফন্ট কনর্ভাটার ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ফন্ট কনভার্ট করা যাচ্ছে। বাংলায় ওয়েবসাইট তৈরি হচ্ছে। মোবাইলে বাংলা ভাষায় লেখা যায়, এসএমএস করা যায়। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর হাজার খানেক অ্যাপস তৈরি হয়েছে। এখনও নতুন নতুন বাংলা অ্যাপস তৈরি হচ্ছে। বাংলা ভাষায় ই-বুক প্রকাশিত হচ্ছে। প্রযুক্তির এই যুগে ভাষার লড়াই এখনও শেষ হয়নি; বরং নবতর মাত্রা পেয়েছে। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বাংলা ভাষার লড়াইকে জারি রাখতে হবে।

আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলা ভাষা

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষার গৌরবকে তুলে ধরেন। জাতিসংঘে আগে কেউ এভাবে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরার ঘটনা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এটিই প্রথম নয়। ১৯৫২ সালে চীনে বিশ্বশান্তি সম্মেলনেও তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বলেন, “পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে কথা বলতে পারি। তবু মাতৃভাষায় কথা বলা আমার কর্তব্য।” ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের ৫১তম অধিবেশনে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বাংলায় বক্তৃতা দেন। পরবর্তীতেও তিনি তার এই ধারা অব্যাহত রেখে সাধারণ সভায় বাংলায় বক্তব্য রেখেছেন।

জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা

জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ৬টি। মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব-ভাষা তালিকায় বাংলা ভাষার অবস্থান পঞ্চম এবং ৩৫ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা এখনও জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের একটি দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করি, বাংলা ভাষা একদিন জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

অর্থনৈতিক মুক্তি ও উন্নয়নের রোল মডেল

মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে আন্দোলনের সূচনা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়েই তার পূর্ণতা। আর তাই বাঙালি জাতির সমগ্র সত্তাজুড়েই সতত বহমান একুশের চেতনা।

ভাষাকে নিয়ে যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, সেই স্বপ্নই আমাদের আপসহীন করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উজ্জীবিত করেছে স্বদেশপ্রেমের মন্ত্রে, আত্মবিশ্বাসী করেছে উন্নয়নের দীক্ষায়। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা মুক্তির সংগ্রামের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্য থেকে মুক্তি, শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি। আর তাই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি যদি না আসে, তাহলে সবকিছু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

আমরা সৌভাগ্যবান যে বঙ্গবন্ধুর কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সুদক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য একটি উন্নত জীবন নিশ্চিত করা হচ্ছে। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি উন্নয়নকেও মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। শিক্ষা খাতে অভাবনীয় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে মানুষের জীবনমানের গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। জঙ্গিবাদকে কঠোরভাবে দমন করা হচ্ছে।

ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ গর্ব করতে পারে এ-কারণে যে, বাংলাভাষীদের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

লেখক : সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, উত্তরণ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত