1815
Published on মার্চ 3, 2022স্কোয়াড্রন লিডার (অব) এম সাদরুল আহমেদ খান:
বিংশ শতাব্দী মহান নেতাদের কয়েকটি যুদ্ধবক্তব্য উপহার দিয়েছিল, যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ দিয়েছিল, নেতারা তাদের বক্তৃতা এবং দুর্দান্ত নেতৃত্বের দ্বারা মানুষকে বোঝাতে, সংগঠিত করতে এবং উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। এমনই কয়েকটি উল্লেখ করার মত যুদ্ধবক্তব্য ছিল ১৯৪০ সালের ১৩মে ব্রিটেনের প্রধান মন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল যুদ্ধবক্তব্যর মাধ্যমে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী কে জার্মান এর বিরুদ্ধে “ব্যাটল অব ব্রিটেন ‘ যুদ্ধের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন, এই যুদ্ধে জার্মান বিমান বাহিনীকে পরাস্ত করতে না পারলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের পরাজয় নিশ্চিত ছিল। ১৯৪১ সালের ৩ জুলাই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন রাশিয়ার প্রিমিয়ার জোসেফ স্ট্যালিন দখলদার হিটলার এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বক্তব্য রাখেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) ডুইট ডি আইসেনহাওয়ার ১৯৪৪ সালের ৬ই জুন বক্তৃতায় “নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং’ এর যুদ্ধ আদেশ দেন। ১৯৬২ সালের ২২ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তার ভাষণের মধ্য দিয়ে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কটের মুহূর্তে জাতিকে ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
ইতিহাসে সর্বাধিক অনুপ্রেরণামূলক যুদ্ধকালীন ভাষণটি ছিল ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ৭ই মার্চের ভাষণ। যা বাংলাদেশের জনগণকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করেছিল, এই একটি ভাষণ যা বাঙ্গালির ভাগ্যকে চিরতরে বদলে দেয়। ইউনেস্কো ৭ই মার্চের এই ভাষণকে “ডকুমেন্টারি হেরিটেজ” হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং "মেমরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার" এ অন্তর্ভুক্ত করেছে।
৭ই মার্চ ১৯৭১ পাকিস্থানী গোয়েন্দা নথিতে বঙ্গবন্ধুকে “চতুর” হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, “শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমরা (পাকিস্থানিরা) কিছুই করতে পারলাম না। “
সামরিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি, সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবের স্বাধীনতা যুদ্ধের 'ক্যাম্পেইন প্ল্যান’ (যুদ্ধ পরিকল্পনা) হিসাবে পরিগনিত করা যায়। আবার অধিনায়ক হিসাবেও তিনি তার অধস্তন অধিনায়াকদের কাছে আক্রমণের পরিকল্পনা, বর্তমান পরিস্থিতি, শত্রু বাহিনী, বন্ধু বাহিনী, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন, তাই এটি ছিল যুদ্ধের একটি “অপারেশন অর্ডার’ (অভিযানের আদেশ)।
যুদ্ধে “ক্যাম্পেইন প্ল্যান’ (যুদ্ধ পরিকল্পনা) হ'ল কমান্ডারের সামরিক কৌশলগুলির বহিঃপ্রকাশ, ক্যাম্পেইন প্ল্যান যুদ্ধে জয়ের জন্য কীভাবে অপারেশন এবং লজিস্টিক পরিচালনা করা হবে তা নির্দিষ্ট করে, সামরিক কর্মের ধারণা এবং পরিকল্পনাগুলি বর্ণনা করে।
যুদ্ধে “অপারেশন অর্ডার’ (আভিযানের আদেশ) এ কীভাবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে হয় তা অধস্তন অধিনায়কদের কাছে বিস্তৃত বর্ণনা করা হয়। একটি “অপারেশন অর্ডার’ (অভিযানের আদেশ) এ সার্বিক পরিস্থিতি, মিশন, তথ্য, গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য সহায়ক কার্যক্রম বর্ণনা করা হয়।
৭ইমার্চ ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আক্ষরিক অর্থে “ক্যাম্পেইন প্ল্যান’ এবং” অপারেশন অর্ডার’ উভয়ই প্রচার করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতায়, “অপারেশন অর্ডার’ (অভিযানের আদেশ) এর সমস্ত উপাদান ছিল, যেমনঃ
১। পরিস্থিতি (Situation)
ক। শত্রু বাহিনী
খ। বন্ধু বাহিনী
গ। সংযুক্তি -বিযুক্তি
২। মিশন (Mission)
৩। বাস্তবায়ন (Execution)
ক। অভিযান কৌশল
খ। সাব ইউনিট অভিযান
গ। সমন্বয় নির্দেশ
৪। সেবা সমূহ; (Service Support)
ক। প্রশাসন
খ। পরিবহন
গ। মিডিয়া
ঘ। কর্মী/জনতা
৫। কমান্ড, কন্ট্রোল, যোগাযোগ, গোয়েন্দা তথ্য (সি-৩ আই): (Command-Control-Communication-Intelligence, C-3I)
সামরিক বিশ্লেষণ থেকে ৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা যায়। ৭ই মার্চের ভাষণে যুদ্ধের জন্য “অপারেশান অর্ডার’ (আভিযানের আদেশ) এর সমস্ত বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত ছিল, এমনকি এটি আরও বিস্তৃত ছিল।
১। পরিস্থিতি;
ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন - আমরা মেনে নিলাম।
ক। শত্রু বাহিনী
আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।
খ। বন্ধু বাহিনী
তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
গ। সংযুক্তি –বিযুক্তি
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।
২। মিশন;
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম
৩। অভিযান বাস্তবায়ন ;
ক। অভিযান কৌশল
১। টাইম ওভার টার্গেটঃ আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় - তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।
২। হামলা প্রস্তুতিঃ তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।
৩। D-DAY হামলা বাস্তবায়নঃ তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু - আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।
খ। সাব ইউনিট অভিযান
২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, - মার্শাল ল সামরিক আইন’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।
৪। সেবা সমুহ;
ক। সরবরাহ/ প্রশাসনঃ
আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাঁচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।
২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে।
খ। পরিবহনঃ
গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে
গ। মিডিয়াঃ
মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না।
ঘ। কর্মী/জনতাঃ
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন।
৫।কমান্ড-কন্ট্রোল-যোগাযোগ-গোয়েন্দা তথ্য (সি-৩ আই),
ক। কমান্ড-কন্ট্রোল
সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।
খ। যোগাযোগঃ
টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।
গ। গোয়েন্দা তথ্যঃ
মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।
------------------------------- জয় বাংলা---------------------------------
৭ই মার্চের ভাষণকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য রণকৌশল হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। একাত্তরের শুরুতে ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ আদেশ।
আমি ভারতীয় দূতাবাস এর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সাথে কলকাতায় “বিজয় দিবস উদযাপন -২০১৭ তে অংশ নিয়েছিলাম। প্রতিনিধি দলের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের ৬০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের সময়, আমি অনেক বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সাথে আলাপ করেছি। তাদের সকলের বক্তব্য ছিল যে বঙ্গাবন্ধু একটি “ডিফেন্সিভ কাউন্টার অ্যাটাক “ যুদ্ধ কৌশল নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক বাড়িকে দুর্গ এবং কখনও আত্মসমর্পণ না করার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পথ প্রশস্ত করেছিল।
বঙ্গবন্ধু তার যুদ্ধ বক্তৃতায় ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতা ও নির্যাতনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, “আমাদের রক্তে রাস্তা লাল ছিল, আমাদের মা-বোনদের কোল খালি করেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। সেই সময় আমাদের একমাত্র পথ ছিল "মুক্তিযুদ্ধ"। ৭ই মার্চ ভাষণ ছিল একটি "অপারেশন অর্ডার", বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত কার্যকর বর্ণনায় নেতা কর্মীদের সঠিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি শত্রু এবং বন্ধু বাহিনীকে চিহ্নিত করেছেন।
তাঁর মিশন ছিল স্পষ্ট , এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম “। এটি কার্যকরভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল। তিনি একটি “ডিফেন্সিভ কাউন্তার অ্যাটাক” যুদ্ধ কৌশল প্রচার করেছিলেন, “আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় - তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।“
অভিযান কৌশলে তিনি আদেশ দিয়েছেন। , " তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। বঙ্গবন্ধু শত্রুদের গতিপথ বাধাগ্রস্থ , আর চলাচলে বিলম্ব সাধন করতে “বিলম্ব-বিকল্প-ধ্বংস” পদ্ধতি গ্রহন করে আদেশ দিয়েছিলেন, "তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু - আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।
তিনি শর্তসাপেক্ষে আলেচনার পথও রেখেছিলেন, "আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম- মার্শাল ল সামরিক আইন’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না।
তিনি বাহ্যিক আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ নাশকতা কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য কুইক রেসপন্স ফোর্স (কিউআরএফ) হিসাবে কাজ করার জন্য একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন, তাঁর সমন্বয়মূলক নির্দেশনা ছিল, " প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। "
সেবা সমুহ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, “ আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাঁচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে"
মিডিয়া "অপারেশনস অর্ডার" এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যুদ্ধে মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বঙ্গবান্ধু প্রিন্ট, রেডিও এবং টেলিভিশন মিডিয়া কর্মীদের সজাগ থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। সমস্ত সংবেদনশীল নথি সুরক্ষিত রাখতে, বাংলাদেশের খবর বহিঃ বিশ্বে সম্প্রচার করতে বলেন। অন্যথায় কোনও বাঙালির যেন রেডিও এবং টেলিভিশন স্টেশনে না যায়।
কর্মী/জনতা বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন, শহীদ পরিবার এবং আহত ব্যক্তিদের যত্ন নিতে হবে। তিনি জরুরি অপারেশনাল প্রয়োজনীয়তা (ইওআর) পূরণের জন্য একটি তহবিল তৈরির কথা বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।“এভাবেই তিনি শত্রুর যুদ্ধ পরিচালনার সক্ষমতা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন “অপারেশনস অর্ডারে” খুবই জরুরী বিষয়। বঙ্গবন্ধু সচেতন করে বলেছিলেন, “মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে।“ তিনি গোয়েন্দা প্রতিবেদন পেয়েছিলেন যে শত্রুরা একটি সাম্প্রদায়িক ট্রাম্প কার্ড (হিন্দু / মুসলিম সহিংসতা) খেলবে। এই বিষয়ে তাঁর আদেশ ছিল স্পষ্ট, “এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।“
সুতরাং, উপসংহারে বলাই যায় , ৭ই মার্চের ভাষণটি একই সাথে ছিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা। একজন রাজনৈতিক নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের সুপ্রিম কমান্ডার হিসাবে একটি চমৎকার যুদ্ধ পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একা, মানুষের সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, কোনও বিরতি ছাড়া, লিখিত নোট ছাড়া এবং কারো কোনও সহায়তা ছাড়া একটি যুদ্ধ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল একটি বিপ্লব, যা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুত্রপাত ঘটায়, দীর্ঘ নয় মাস প্রাণপণ লড়াইয়ের পরে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছিলাম। আর একারনেই, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরেও ৭ই মার্চের ভাষণটি আজও আমাদের জীবনে এতো তাৎপর্যপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে দিনগুলিতেও অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে থাকবে।
লেখকঃ সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-এট-আর্মস; সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ