1338
Published on ফেব্রুয়ারি 24, 2022ড. প্রণব কুমার পান্ডে:
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ক্ষমতায় এসে দিনবদলের সনদ বাস্তবায়ন শুরু করে। দিনবদলের সনদের মূল বিষয় ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা যার ভিত্তি হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বাংলাদেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে গত ১৩ বছরে যার ফলে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে বাংলাদেশের কোন নাগরিক কিংবা পৃথিবীর অন্য দেশের কোনো নাগরিক কল্পনাই করতে পারত না যে মহাশূন্যে বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাবে।
কিন্তু এই অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের পতাকা সম্বলিত স্যাটেলাইট এখন মহাশূন্যে অবস্থান করছে। পাশাপাশি দেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে যার প্রভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২৫০০ ইউএস ডলার অতিক্রম করেছে। ২০০৮ সালে জুন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭৪৭০.৯০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। সেই অবস্থা থেকে ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮০৬০ মিলিয়ন ইউএস ডলারে পৌঁছেছে। তাছাড়া, সরকার পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের সক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জনগণের কাছে সমাদৃত হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তেমনই একটি ব্যতিক্রমী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সেটি ছিল দেশে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু চালু করা। এটি সত্যিই একটি ব্যতিক্রমী কিন্তু বাস্তবসম্মত অঙ্গীকার ছিল কারণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটা বয়সের পরে মানুষের আয় করার সক্ষমতা থাকেনা। ঠিক সেই সময় রাষ্ট্র যদি তাদের পাশে না দাঁড়ায়, তবে সেই সকল জনগণের পক্ষে জীবন নির্বাহ করা খুব কঠিন হয়ে যায়।
তাছাড়া সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা শিরোনামে ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা রয়েছে: ১৫। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়: (ঘ) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার। সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদকে মাথায় রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেদিন জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন যে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গেলে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হবে। আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত ইউরোপ ও নর্থ অ্যামেরিকার বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি চালু থাকতে দেখেছি। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের একটি মূল দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের বিপদের সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো। ইউরোপের দেশগুলোতে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু থাকার ফলে জনগণকে তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে তেমন চিন্তা করতে হয় না। সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহার এই প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মতো তিনি শুধুমাত্র জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েই থেমে থাকেন নি। তিনি সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য সব সময় সচেষ্ট রয়েছেন। আমরা বিভিন্ন সময়ে তাঁকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে তাগিদ দিতে দেখেছি। অতি সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে অতি দ্রুত সার্বজনীন পেনশন চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি খসড়া রূপরেখা তৈরি করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এই সার্বজনীন পেনশন কার্যক্রম শুরু হবে।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় ১৮ বছর বয়সী কেউ প্রতিমাসে ১০০০ টাকা করে পেনশন তহবিলে জমা দিলে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত তার জমার পরিমাণ হবে ৫ লাখ টাকা। ৪২ বছর ধরে এই পরিমাণ টাকা জমা দিলে বয়স ৬০ বছর অতিক্রম করার পর আমৃত্যু প্রতিমাসে ৬০,০০০ টাকা হারে পেনশন পাবেন তিনি। ১৮-৬০ বছর বয়সী যে কেউ নিজের ভোটার আইডি নম্বর ব্যবহার করে পেনশন অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন। ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের পেনশন চাঁদা বহন করার সক্ষমতা থাকলে তারাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
সর্বজনীন পেনশন প্রথায় থাকছে- কন্ট্রিবিউশন ও ডোনেশন সিস্টেম। কন্ট্রিবিউশন প্রথায়-যার যত টাকা জমা থাকবে, তার তত বেশি পেনশন সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকবে, যা তার শেষ জীবনকে করবে আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময়। অপরদিকে আর্থিকভাবে অক্ষমদেরও বিমুখ করবে না এই উদ্যোগ। যারা কোনো টাকা জমাতে পারবেন না, তাদের জন্য অনুদান দেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন পলিসিতে একটা ন্যূনতম পেনশন-সুবিধা নিশ্চিত করবে, যাতে শেষ জীবনে তাদের কারও মুখাপেক্ষী না হতে হয়। কন্ট্রিবিউশন কিংবা ডোনেশন উভয় পদ্ধতিতেই সর্বজনীন পেনশন সুবিধাভোগীর বয়স হতে হবে ৬০ এবং তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে পেনশন তহবিলে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ষাটোর্ধ্ব হলেই সুবিধাভোগীরা এককালীন অর্থ পাওয়াসহ নিজের জমা অনুযায়ী আজীবন মাসিক অর্থ পাবেন। অন্তর্ভুক্তির পর কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যরা এই সুবিধা পাবেন।
তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এ রকম একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা প্রয়োজন। এছাড়া আইন ও বিধি প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে বিধায় এইটুকু সময় আমাদের সরকারকে দিতেই হবে। যদিও এই কার্যক্রম শুরু হলে এর সুফল পেতে জনগণকে বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু প্রক্রিয়া চালু না হলে সেটি কখনো আলোর মুখ দেখবে না। এ বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। ফলে সার্বজনীন পেনশন কার্যক্রম চালু করা হলে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নাগরিকরাও মাথা উঁচু করে বলতে পারবে যে আমাদের সরকার কল্যাণকামী সরকার এবং প্রয়োজনের সময় জনগণ তাদেরকে পাশে পায়।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে একটি ফারাক থাকে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের সরকারের অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে ভঙ্গুর অর্থনীতির পড়ে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরলস ভাবে চেষ্টা করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলবার। আজ থেকে ঠিক এক যুগ আগেও যারা বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করেছিল, তারাই আজকে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। এই স্বীকৃতি এমনিতে আসে নি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল অদম্য সাহস এবং উদ্দীপনার। বাংলাদেশের পূর্ববর্তী কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বই এ রকম সাহস প্রদর্শন করে নি যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১৩ বছরে করে দেখিয়েছেন। জনগণের এবং পৃথিবীর সামনে তিনি প্রমান করেছেন কিভাবে কম সাধ্য দিয়ে অধিক সাধ পূরণ করতে হয়। সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি একের পর এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।
গত দুই বছরের ওপরে চলমান কোভিড-১৯ অতিমারির নেতিবাচক প্রভাবে পৃথিবীর বড় বড় অর্থনীতি যখন স্বাস্থ্য খাত এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দূর করতে ব্যস্ত রয়েছে, ঠিক সেই সময়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। যখন বড় বড় দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের নিচে, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ ৬ শতাংশের উপরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে যা পৃথিবীর বুকে বিরল দৃষ্টান্ত। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার কারণে যখন জনগণের মধ্যে বিশৃংখলা দেখা গেছে, ঠিক সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শক্তভাবে স্বাস্থ্য খাতে এবং অর্থনৈতিক খাতে করোনার প্রভাব মোকাবেলা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে খেটে খাওয়া মানুষকে যথেষ্ট পরিমান সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
এই রকম একটি অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে সার্বজনীন পেনশন কার্যক্রম চালু করার স্বপ্ন দেখছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। তিনি তাঁর অল্প সময়ের শাসনামলে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর বাবার আদর্শকে ধারণ করে দেশে উন্নয়নের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে আজ বাংলাদেশ এশিয়ান টাইগার বা উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্যান্য ব্যতিক্রমী উদ্যোগের মত সার্বজনীন পেনশন কার্যক্রম চালু হলে ভবিষ্যতে জনগণের মধ্যে এক ধরণের নিরাপত্তার বোধ জন্ম নিবে। আজ বয়স্ক মানুষরা যেভাবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে, সেই ভাবনা তাদের মধ্যে আর থাকবে না। আর এই কারনেই শেখ হাসিনাকে জনবান্ধব রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যা প্রদান করা যেতেই পারে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর