1434
Published on ফেব্রুয়ারি 21, 2022বিপ্লব বড়ুয়া:
বিশ শতকের চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আজও আশা করে আছি পরিত্রাণ কর্তা আসবে সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে চরম আশ্বাসের কথা শোনাবে পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’
বাংলার ভাগ্যাকাশে সেই পরিত্রাণ কর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা আন্দোলন-বাংলা-বাঙালি-বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ। পৃথিবীতে শুধু বাঙালি জাতিরই বিশেষ একটি বিশেষত্ব আছে, আর তা হলো বাঙালির মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা উভয়-ই ‘বাংলা’। আবার দেশের নাম অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে ‘বাংলা’ শব্দটি জড়িয়ে আছে। ‘Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation, Bangladesh: Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’ শীর্ষক গোয়েন্দা রিপোর্ট (যদিও অনেক রিপোর্ট পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নষ্ট করেছে) প্রকাশের পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও ভূমিকার কথা আরও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
জাতির পিতা শুধু বাঙালির স্বাধীনতা এনে দেননি, তিনি বাঙালির ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ছিলেন অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা করেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব, অতঃপর রাষ্ট্রভাষার অধিকার আদায়, বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং স্বাধীনতার পরেও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মূলত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন করার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালির স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জন্মের আগেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির আসল রূপ উন্মোচিত হতে থাকে এবং একই সঙ্গে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের যুবসমাজ নিজেদের অধিকার রক্ষার চিন্তা করতে শুরু করে। প্রথম বৈঠকটি হয়েছিল কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলের একটি কক্ষে। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন– কাজী ইদ্রিস, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, রাজশাহীর আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান আরও কয়েকজন। আলোচ্য বিষয় পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের যুবসমাজের করণীয় কী?
এর কয়েক দিন আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এক নিবন্ধে বলেছিলেন, প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তারও পূর্বে, যখন পাকিস্তান সৃষ্টির কথাবার্তা চলছে, তখন বাংলাকে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর এই দাবি প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ৬-৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। এ সম্মেলনে ভাষা বিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এসব প্রস্তাব পাঠ করেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া ইউক। এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ [সূত্র: ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’, গাজিউল হক; ‘ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু’, বঙ্গবন্ধু গবেষণা কেন্দ্র, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪]
এভাবেই ভাষার দাবি প্রথমে উচ্চারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ভারত থেকে নিজের মাতৃভূমি তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক হন। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন। সেই সময়ের তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক চলাকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অনুষ্ঠিত মিছিলে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্বদান করেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। এই ইশতেহারের দ্বিতীয় দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ইশতেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’। পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। [রাষ্ট্রভাষা-২১ ইশতেহার: ঐতিহাসিক দলিল, শায়খুল বারী, পুনঃপ্রকাশ, জানুয়ারি ২০০২]।
পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার মাসের মধ্যেই পুস্তিকাটির প্রকাশনা ও প্রচার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য পাকিস্তান নামের স্বপ্ন সম্পৃক্ত মোহভঙ্গের সূচনার প্রমাণ বহন করে। ১৯৪৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন। তিনি সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আন্দোলনে শরিক হন। ২ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত ও মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দুজন করে প্রতিনিধি যোগদান করে। এই পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। এ পরিষদ গঠনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় ছিলেন। ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইতোমধ্যে সরকারের সঙ্গে আঁতাতকারীদের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। অনেকেই তখন দোদুল্যমানতায় ভুগছে, সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। একটি বজ্রকণ্ঠ সচকিত হয়ে উঠলো, সরকার কি আপসের প্রস্তাব দিয়েছে? নাজিমুদ্দিন সরকার কি বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে তবে আগামীকাল ধর্মঘট হবে, সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং হবে। ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে সমর্থন দিলেন অলি আহাদ, তোয়াহা, মোগলটুলীর শওকত সাহেব, শামসুল হক সাহেব। আপসকামীদের ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেলো। এ সম্পর্কে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে অলি আহাদ বলেছিলেন- ‘সেদিন সন্ধ্যায় যদি মুজিব ভাই ঢাকায় না পৌঁছতেন তাহলে ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিং কিছুই হতো না’ [সূত্র : ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’, অলি আহাদ]। ১১ মার্চ হরতাল হয়েছিল, পিকেটিং হয়েছিল সেক্রেটারিয়েটের সামনে, সেখান থেকে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়েছিলেন।
১১ মার্চ ১৯৪৮ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। এ প্রসঙ্গে জাতির পিতা তাঁর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচায় (বাংলা একাডেমি-২০১৭ থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-২০৬) লিখেছেন, ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ওইদিন ১০টায় আমি, শামসুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদসহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হন।’ ১১ মার্চের হরতাল সফল করতে ১ মার্চ ১৯৪৮ প্রচার মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষর করেছিলেন। জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসে এই বিবৃতির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
১৫ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জেলখানায় আটক ভাষা সংগ্রামী ও রাজবন্দিদের চুক্তিটি দেখানো ও অনুমোদন নেওয়া হয়। অনুমোদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ মুজিব ও অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন।
এই চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার দেশবাসীর কাছে নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃত্বকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করে। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং তীব্র প্রতিবাদ করেন।
১৬ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেন। ১৭ তারিখে দেশব্যাপী শিক্ষায়তনে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ওই দিনের ধর্মঘট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ দৃঢ়চেতা এবং অসম সাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্রসমাজে ওই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকেন। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেই ছাত্রনেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পদত্যাগ করলে ক্ষমতার পালাবদলে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুরে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আন্দোলন শুরু করে এবং ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত প্রতি বছর ‘ভাষা আন্দোলন দিবস’ (১১ মার্চকে) হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেফতার করা হয়। একই বছর জুলাই মাসের শেষে তিনি পুনরায় মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে জনসভা শেষে বঙ্গবন্ধু ভুখা মিছিল বের করেন। ওই মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা-২০১৭, পৃষ্ঠা-৫)। বেশ কিছু দিন পর বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটকে রেখে মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেল থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরামর্শ দিতেন।’ ভাষাসৈনিক, প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা প্রবন্ধে বলেছেন- “শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।’ [সূত্র: একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক, ড. মোহাম্মদ হান্নান, পৃষ্ঠা- ৫৩]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে জেলখানার সে ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এসো।’ আর দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসলো। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। এ দাবিতে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করবো। মহিউদ্দিন জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেবো। তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দিবে। আমাদের অনশনের নোটিশ দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর জেলে তাদের মুক্তির দাবিতে অনশন করছেন। তারা শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন।’
জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভাষা-আন্দোলনের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার এই মত পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তাঁর সমর্থন আদায় করেন [সূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক, ড. মোহাম্মদ হান্নান, পৃষ্ঠা- ৫৩]। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ওই বছর জুন মাসে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাঁকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।’ বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষার প্রতি গভীর দরদ অসীম রাজনৈতিক প্রত্যয়ের ফলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সমর্থন করে বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতিটি ২৯ জুন ১৯৫২ সাপ্তাহিক ইত্তেফাক (ইত্তেফাক ১৯৪৯-৫৩ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে থাকলেও ২৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩ দৈনিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে এই পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়. আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।’
বাংলার কোনও কোনও নেতা বাংলা ভাষার দাবির ব্যাপারে বিপক্ষে অবস্থান করলেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে তারাও ভাষার দাবি আদায়ে শামিল হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে কোনোভাবে হেলাফেলা না করার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে সতর্ক করে দেন। ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬ অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু সংসদের দৈনন্দিন কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণ করার দাবি জানান। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনও ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক’। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রের অন্তর্গত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত প্রশ্নে বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গে আমরা সরকারি ভাষা বলতে রাষ্ট্রীয় ভাষা বুঝি না। কাজেই খসড়া শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের ভাষা সম্পর্কে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা কুমতলবে করা হয়েছে।’ ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের আইন সভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। [সূত্র : ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’, ভাষা আন্দোলনের ৫০ পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্মারক গ্রন্থ, মার্চ ২০০২, পৃষ্ঠা-১৮২-১৯১]
ভাষাসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেতার পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। বাংলা ভাষা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পর্বে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় গর্জে ওঠেন এবং মহানায়কের ভূমিকা পালন করেন।
সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান এবং অবিলম্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু সমকালীন রাজনীতি এবং বাংলা ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখেন।
পরবর্তীকালেও তিনি বাংলা ভাষা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকারের সেই একই দাবি ও কথাগুলো আরও বর্ধিত উচ্চারণে জাতির সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন। একমাত্র বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায় এবং বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মূল নায়ক ও স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা আন্দোলনেরই সুদূরপ্রসারী ফল।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। তার চিন্তা-চেতনায় ছিল মাতৃভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি বিধানের সংকল্প। বাঙালিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এ চেতনা ছিল সর্বদা সক্রিয়। এ ব্যাপারে তিনি আমৃত্যু ছিলেন আপসহীন, কঠোর। বাঙালি জাতি তার এই ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা কখনও ভুলবে না।
লেখক: ব্যারিস্টার; দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সৌজন্যেঃ বাংলা ট্রিবিউন