বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন ও বাঙালি জাতির উত্থান: ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য আলেখ্য

3714

Published on জানুয়ারি 8, 2022
  • Details Image

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ। আত্মসমর্পণ করেছে পাকিস্তানি বর্বর জান্তারা। বাংলার আকাশে উড্ডীন লাল-সবুজের বিজয়ী পতাকা। স্বজন হারানোর চাপা বেদনা ও শৃঙ্খলমুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত বাঙালি জাতি। কিন্তু সবার মনের কোণেই বিষাদের ঘনঘাটা। যার ডাকে আপামর বাঙালির এই যুদ্ধে নামা, যার জন্য বাংলাদেশের জন্ম, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের অন্ধকার জেলে বন্দি। পাকিস্তানি জান্তারা তখনো তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই অজানা আশঙ্কায় বাঙালির বিজয়ের আনন্দ অপূর্ণই থেকে যায়।

পরাজয়ের ঠিক আগের রাতে জেলের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়ে হত্যার শেষ অপচেষ্টা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তা আর বাস্তবায়ন করতে পারেনি পাকিস্তানি জান্তারা। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। ৯ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে, ১০ জানুয়ারি নিজের সৃষ্ট দেশে প্রত্যাবর্তন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

সেই বৃষ্টিস্নাত বিকালে, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে, তখন ঢাকার রাস্তায় আনন্দঅশ্রুতে মথিত হতে থাকে লাখ লাখ জনতা। তাকে একনজর দেখেই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে বাঙালি জাতি, ফিরে এসেছেন জাতির পিতা। 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে চারপাশ। বিমান থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু সরাসরি চলে যান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

এরপর নতুন করে দেশকে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আবেগী অথচ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর মুখে দিকে তাকিয়ে, তার কণ্ঠের মূর্চ্ছনায়, আবেশিত হয়ে যায় পুরো বাংলাদেশ। প্রতিটি বাঙালির হৃদয় পরিণত হয় পুষ্পবৃষ্টির ফেনিল সায়রে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত বিজয় পূর্ণতা লাভ করে এই ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে বিজয় লাভ হলেও,  ১০ জানুয়ারি তা পরিপূর্ণতা পায়।

ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের প্রথম প্রত্যাবর্তন:

১৯৪৭ সালের আগস্টে দুইভাগে ভাগ হলো ভারতবর্ষ, মধ্যখানে বিশাল ভূখণ্ডের ভারত আর তার পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দুই পৃথক সংস্কৃতি ও জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে গড়া হলো পাকিস্তান। শুধু ধর্মের মিল ছাড়া এই দুই বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের জাতিগুলোর মধ্যে আর কোনো মিলই ছিল না। সেটাকেই কাজে লাগায় চতুর ও ধূর্ত পাকিস্তানিরা। বাংলার সরলপ্রাণ মানুষদের ধোঁকা দিয়ে দাস বানিয়ে ফেলে তারা। দেশভাগের পরপরই তারা বাংলার মানুষের হাজার বছরের ভাষা ও সংস্কৃতি বদলে দেওয়ার নীলনকশা করে। কিন্তু ছাত্ররা তা শুরুতেই বুঝতে পারে। ফলে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শুরু হয় তীব্র প্রতিবাদ। 

অখণ্ড ভারতের কলকাতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। দেশ ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন তিনি। দেশের মানুষের ওপর যাতে পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে না পারে, সেজন্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়ে জনসংযোগ শুরু করেন তরুণ মুজিব। এরপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সেদিন সচিবালয়ের সামনে থেকে শেখ মুজিবসহ আরো অনেক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ভাষা আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। ফলে ১৫ মার্চ শেখ মুজিবসহ বাকি সবাইকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।

এরপর ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেওয়ার পর অ্যাসেম্বলি ঘেরাওয়ের জন্য সবাইকে নিয়ে অগ্রসর হন। পরবর্তীতে শেরে বাংলার মতো বর্ষীয়ান নেতাও শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

জেলের রাজবন্দি থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে ফিরে আসা:

মূলত, ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মূল ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘটের সময়, এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত সারা দেশের ছাত্রসমাজকে বাংলা ভাষার দাবিতে একাট্টা করে ফেলে। ফলে ১৯ মার্চ সোহরাওয়াদী উদ্যানে ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিল; তখন নিশঙ্ক চিত্তে সবাই একযোগে 'না' 'না' বলে প্রতিবাদের ঢেউ তোলে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সামনে থেকে যারা জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যেও অন্যতম একজন ছিলেন শেখ মুজিব। এরপর ভাষা আন্দোলন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায়, ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবারো শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৪৯ সালে তিনি মুক্ত হলেও বেশিদিন বাইরে থাকতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকারের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয় এবং প্রধানত ভাষা আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য ১৯ এপ্রিল তাকে আবারো জেলে ঢোকায় পাকিস্তানিরা। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে জেলে থাকা অবস্থাতেই, (২৩-২৪ জুন) আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক হন তিনি। কারামুক্ত হয়ে, ২৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগের প্রকাশ্য সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদরদফতর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরের দাবি জানান তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

আওয়ামী লীগের মধ্যমণি এবং মন্ত্রী হিসেবে আবির্ভাব:

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের প্রাথমিকপর্বেই, স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদের মূল কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়ায়, শেখ মুজিবের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় পাকিস্তানিরা। ফলে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি তাকে আবারো গ্রেফতার করে জান্তারা। তিনি জেলে থাকা অবস্থাতেই নিয়মিত যোগাযোগ ও নির্দেশনা দিতে থাকেন ছাত্রলীগসহ সমমনা ছাত্রনেতাদের। ফলে তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

এর আগেই, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে, ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণা দেন শেখ মুজিবুর রহমান। একইসঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বুকের রক্ত ঢেলে দেয় ছাত্র-জনতা। অবশেষে জনদাবির মুখে ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার।

এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেশজুড়ে গণমানুষের কাছে ছুটতে থাকেন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশের মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের মধ্যমণি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। গোপালগঞ্জের প্রভাবশালী মুসলীম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে বিশাল ভোটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এরপরেই প্রাদেশিক সরকারের কৃষি, বন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘরে বাঙালির প্রত্যাবর্তন:

আপামর বাঙালির ভোটে ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক সরকারকে দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্র করে বাতিল করে। এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে প্রায় ৭ মাস জেলে রাখে। এরপর ১৯৫৫ সালে গণপরিষদের সদস্য হন তিনি। পল্টন ময়দানের প্রকাশ্য জনসভায় বাংলার স্বায়ত্তশাসনসহ একুশ দফার দাবি তোলেন। একই বছর দলের নাম থেকে মুসলিম অংশটি বাদ দিয়ে 'বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ' নামকরণ করা হয় শেখ মুজিবের প্রস্তাবে।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ১৯৫৪ সালে ২২৩ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগের মাত্র ৯ আসন ও আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৪৩ আসন প্রাপ্তির পর, পাকিস্তানিদের ধর্মের ভণ্ডামির খোলস উন্মোচিত করে, শেখ মুজিব এই সিদ্ধান্ত নেন। বাংলার মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বের করে, উন্নত অর্থনীতি ও সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি এই সংস্কার সাধন করেন। পরবর্তীতে তার এই আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাত কোটি বাঙালি একত্রে স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে।

১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়েও, ১৯৫৭ সালের মে মাসে সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ মুজিব। কারণ, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতিকে একাট্টা করার ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় প্রদানের উদ্দেশ্যে তিনি এই ত্যাগ স্বীকার করেন। এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেশজুড়ে সফর করে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন ছড়াতে শুরু করেন।

রাজনীতির মরা গাঙে মুক্তির প্রবাদপুরুষ হিসেবে ফিরে আসা:

১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসন জারি হয় পাকিস্তানে। সঙ্গে সঙ্গে আবারো আটক করা হয় আওয়ামী লীগের মধ্যমণি শেখ মুজিবুর রহমানকে। বর্ষীয়ান নেতারা এসময় রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার মুচলেকা দিতে বাধ্য হন। মূলত ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবকে কখনো জেলে, কখনো গৃহবন্দি, কখনো এক মামলা থেকে থেকে মুক্তি দিয়ে আরেক মামলায় গ্রেফতার করে জান্তারা। তবে ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির বাসায় আয়োজিত কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকে আবারো আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করা হয়।

একইসঙ্গে স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন জোরদার করে তোলা হয় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। ফলে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি জান্তারা দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জেলে নেয় তাকে। বের হওয়ার পর ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আয়োজিত বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে 'আমাদের বাঁচার দাবি' শিরোনামে 'ছয় দফা' পেশ করেন তিনি। এরপর এর সমর্থনে গণজোয়ার সৃষ্টি হয় বাংলার মাটিতে।

এরমধ্যেই উপমহাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন একসময়ের সাবেক ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিন মাসে ৩২টি জনসভা করার পর, ৮ মে গ্রেফতার করা হয় তাকে। ৭ জুন ছয় দফার সমর্থনে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। শেখ মুজিব, ছয় দফা ও বাঙালির অধিকার- একে অপরের পরিপূরক হয়ে যায় এসময়।

ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে বাংলার মানুষের একক কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রত্যাবর্তন:

ছয় দফা ঘোষণার পর, ১৯৬৬ সালের ৮ জুন শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে গণআন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে পাকিস্তানিরা। তবে মুজিবমন্ত্রে ততদিনে জেগে উঠেছে বাঙালির ঘুমন্ত হৃদয়। জেলে থাকা মুজিব যেনো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলেন। ঘরে ঘরে ছড়াতে থাকলো ছয় দফার দাবিগুলো। এরমধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯৬৮ সালে 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য' শিরোনামে একটি মামলা দায়ের করলো জান্তারা। গোপন বিচারের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে হত্যার এই অপচেষ্টা বুঝে গেলো জেগে ওঠা জনগণ।

ফলে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি এবং ছয় দফা বাস্তবায়নের জন্য যুৎপথ আন্দোলনে রাজপথ দখল করলো বাংলার ছাত্র-শ্রমিক-কৃষকসহ সর্বোস্তরের মানুষ। দেশভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত, বাংলার মাটিতে এটাই ছিল সর্ববৃহৎ ও সবশ্রেণির মানুষের সমন্বিত আন্দোলন। শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি পরিণত হলো তীব্র স্বৈচারচারবিরোধী গণআন্দোলনে।

ফলে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সব আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো সরকার। ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ লক্ষ জনতার হর্ষধ্বনিতে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে সন্মানিত করা হলো। বাংলার মানুষের একক কণ্ঠস্বরে পরিণত হলেন তিনি। পদত্যাগে বাধ্য হলো জেনারেল আইয়ুবের জান্তা সরকার। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর সভায় তিনি এই ভূখণ্ডকে 'বাংলাদেশ' বলে অভিহিত করেন। 

হাজার বছরের 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা' থেকে বাঙালির 'জাতির পিতা':

বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং বাঙালির আপোষহীন আন্দোলনের মুখে প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো নতুন স্বৈরাচার জেনারেল ইয়াহিয়া। এসময় লন্ডন সফরে গিয়ে প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান বঙ্গবন্ধু। এবং বিবিসেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের একক বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অবশেষে ১৯৭০ সালের সেই নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে মোট ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন ও প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ২৯৮ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আওয়ামী লীগ। জাতিকে শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখানো বঙ্গবন্ধুর কথার ওপর ভরসা করেই বাংলার গণমানুষ একচেটিয়াভাবে নৌকা প্রতীককে জয়যুক্ত করে।

কিন্তু পাকিস্তানি জান্তারা বাঙালির এই জয় মেনে নিতে অস্বীকার করে। বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মতো একটি বাজে পরিস্থিতে ফেলার অপচেষ্টা চালায়। তবে সতর্ক বঙ্গবন্ধু কোনো ফাঁদে পা না দিয়ে, জনগণকে একাট্টা করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ করেই স্থগিত ঘোষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া। ১ মার্চ তার এই ঘোষণার পর উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু হয় দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন।

৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় লাখ লাখ জনতার সামনে 'জাতির জনক' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও রণপরিকল্পনা ঘোষণা করেন তিনি। দেশজুড়ে শুরু হয় ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠতে থাকে প্রতিরোধ কমিটি। যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের হাতে চলে যায় শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার। বাংলাদেশ চলতে থাকে শেখ মুজিবের কথায়। পাকিস্তানি শাসন কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

অবশেষে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়ে বর্বর পাকিস্তানিরা। সঙ্গে সঙ্গে ২৬ মার্চ প্রথম প্রথম প্রহরে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। সেই রাতে এবং পরের দিনব্যাপী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সেই বাণীর প্রতিলিপি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে আপামর বাঙালি। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে বিশ্বের বুকে উড়তে থাকে লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা। শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিপতি হন বাঙালিরা।

বাঙালির অস্তিত্বে বারবার ফিরে আসবে শেখ মুজিব:

আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তিও রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলেই। তাই যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি সংস্কৃতি থাকবে; ততদিন এই জাতির ধমনীতে প্রবাহিত হবে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’র জয়ধ্বনি। 

বিশ্বের বুকে শেখ মুজিব একজন কিংবদন্তি হিসেবে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে স্তম্ভিত ব্রিটিশ লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেন, 'শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার থেকেও মহান নেতা ছিলেন।' 

পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়, 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনি জনগণের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমিই রাষ্ট্র।'

এদিকে বিবিসির জরিপ অনুসারে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার দেওয়া ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষটিকে বিশ্ব প্রামাণ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ একশ ভাষণের মধ্যে অন্যতম একটি বলে অভিহিত করা হয় বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে। মূলত, শেখ মুজিবুর রহমান হলেন সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি হাজার মাইল দূরের জেলখানায় বন্দি থেকেও একটি জাতিকে মুক্তির জন্য মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

একারণে ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, 'নেপালিয়ন যা পারেনি, মুজিব তা করে দেখিয়েছেন। শুধু তার নামের জ্যোতির্ময় আলোকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি জাতি বিশ্বের মানচিত্র বদলে দিয়েছে। সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে এমন দ্বিতীয় কোনো বিস্ময়কর ঘটনা কেউ কোনদিন, কোথাও প্রত্যক্ষ করেনি।'

বঙ্গবন্ধু শুধু একটি রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করেননি; তিনি একটি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমাধির হাত থেকে রক্ষা করে নতুন প্রাণ দিয়েছেন; তিনি একটি জাতির জন্য সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেই জাতিকে বিশ্বের বুকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক। বাংলা ভাষা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এরপর বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নতুন সংগ্রাম, সর্বক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর নাম ঘুরে ফিরে আসবেই।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত