ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ই-নামজারি

1104

Published on ডিসেম্বর 27, 2021
  • Details Image

এক সময় ভূমিসংক্রান্ত কাজের জন্য ভূমি অফিসে যেতে হবে শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত একটা ভয়ংকর দৃশ্য। নামজারি করতে গেলে ভূমি অফিসের দালালদের চেহারা এবং টেবিলে টেবিলে এই কাগজ সেই কাগজের জন্য ঘোরাঘুরি। একটা কাগজ বের করতে হলে অফিসের লোকজন দেখিয়ে দিত একটি বড় কক্ষ যেখানে হাজার হাজার ফাইল গাদা করা রাখা। সেখান থেকে কাগজ বের করা অনেক সময়ে ব্যাপার। বাড়তি টাকা দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরতে ঘুরতে মেলে না সেই কাগজ। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে এখন প্রেক্ষাপট পাল্টেছে। ই-নামজারি আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। এখন নেই কোনো অভিযোগ। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমির মালিক নিজেই ঘরে বসে আবেদন করছেন। সমাধানও পেয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন রাজশাহীর পবা উপজেলার বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন।

তিনি আরও বলেন, 'এখন ঘরে বসেই অনেকে জমির খাজনা দিচ্ছে। অনলাইনে সবার তথ্য আছে। নিজে না আসতে পারলেও চলে।’ ভূমি অফিসের ভোগান্তির বিষয়টি ছিল সাধারণ একটি সমস্যা। বর্তমান সরকারের ই-গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠায় সেই দিন পাল্টেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আয়োজিত ডিজিটাল ট্যুরে গাজীপুর, রাজশাহী, নাটোর ও যশোরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নামজারিসহ ভূমির বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে এখন তারা কতটা খুশি।

রাজশাহীর পবা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘সকলের তথ্য আমরা অনলাইনে ডেটা এন্ট্রি করেছি। ডেটা এন্ট্রি করে এখন মানুষের মোবাইলে মেসেজ চলে যাচ্ছে। এই বছর তার কত টাকা (খাজনা) বাকি আছে সেটিও মোবাইলে মেসেজে পাওয়া যাচ্ছেন। ভূমির মালিক যদি নিজে এসে টাকা পরিশোধ করতে না পারেন তাহলে অনলাইনে পরিশোধের সুযোগ থাকছে। তিনি নাগরিক নিবন্ধনে গিয়ে অনলাইন পেমেন্ট সিলেক্ট করে ভূমির খাজনা দিলে কিউয়ার সংবলিত অনলাইন পেমেন্টের কাগজ ইমেইলে পেয়ে যাবেন। শতভাগ মিউটেশন কোনো রকম ফিজিক্যাল কাগজপত্র ছাড়াই অনলাইনে নামজারি করে দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ই-নামজারির এ ব্যবস্থাপনাটি সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ভূমি অফিসে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দূরত্ব কমছে।

পবা উপজেলার আসফিয়া ভূমি অফিসে এসেছেন তার বাবার সম্পত্তির বিষয় মীমাংসা করতে। তিনি বলেন, ‘বাবা জীবিতকালে পারেননি কাজটা করতে। প্রতি সপ্তাহে এক, দুই দিন আসতেন আর টাকা দিয়ে যেতেন। এই কাগজ নাই, সেই কাগজ নাই। বাবা মরেই গেলেন। এখন সব অনলাইনে হয়। অনেক সুবিধা হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যে কাজ হয়ে যায়।’

ল্যান্ডডটগভবিডি (land.gov.bd) ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে ইমিউটেশন অর্থাৎ নামজারির মতো সেবা সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে ভূমি অফিস ডিজিটালাইজ করে। আগে প্রচলিত বিধান অনুযায়ী জনগণকে ভূমি অফিসে গিয়ে মিউটেশনের আবেদন করতে হতো। এতে যাতায়াত ছাড়াও অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হতো। এখন ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সহজেই নামজারির জন্য যেকোনো নাগরিক আবেদন করতে পারছেন। এতে সাধারণ মানুষের সুবিধা হচ্ছে। কমছে হয়রানি ও ঘুষ।

ক্রয়, উত্তরাধিকার বা যেকোনো সূত্রে জমির মালিক হলে নতুন মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারি বলা হয়। ভূমি জরিপকালে ভূমি মালিকের মালিকানা নিয়ে যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয় সেটাই খতিয়ান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নামজারির সিস্টেম একটি জটিল প্রক্রিয়া ছিল। হয়রানি, দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতি সবকিছু পেরিয়ে নামজারির কাজটি করতে হতো। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ই-নামজারিকে একটি বিপ্লবই বলেই মনে করছেন সবাই।

জানা গেছে, ই-নামজারির ক্ষেত্রে ব্যক্তি আবেদনে বা এলটি নোটিস প্রাপ্তির পর সাধারণ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৮ কার্যদিবস, প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক হলে মহানগরীর জন্য ৯ কার্যদিবস ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ১২ কার্যদিবস এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার বিনিয়োগবান্ধব শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সাত দিনের মধ্যে নামজারি সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও সাধারণ ক্ষেত্রে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জমির নামজারি সেবা পাচ্ছেন।

ভূমি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ই-নামজারিসহ অন্যান্য সব ভূমিসেবার ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর একটি অংশ। ই-নামজারি কার্যক্রম ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশের সাতটি উপজেলায় পাইলট আকারে শুরু হয়েছিল।

ভূমিসেবা সহজ করতে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলমান উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করা হয়। ওই সভায় পাইলট আকারে গৃহীত ই-নামজারি সিস্টেমটি পর্যবেক্ষণ করে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় দ্রুত সারা দেশে ই-নামজারি বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ী ভূমি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ভূমি সংস্কার বোর্ড উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে হার্ডওয়্যার সরবরাহসহ কানেকটিভিটি নিশ্চিত করে এবং এটুআই প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণ ও ব্যবহারকারী প্রশিক্ষণে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে।

পরে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে সারা দেশে একযোগে শতভাগ ই-নামজারি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এখন তিনটি পার্বত্য জেলা ছাড়া উপজেলা ভূমি ও সার্কেল অফিসে এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ই-নামজারি চালু রয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে জমির মালিকানা নিশ্চিত করতে নামজারির ম্যানুয়াল আবেদন গ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। আইসিটি বিভাগ এবং এটুআই প্রকল্পের সার্বিক সহায়তায় ভূমি সংস্কার বোর্ডের মাধ্যমে অন্যান্য ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে ই-নামজারিও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নামজারি আরও সহজ করতে দলিল মূলে নামজারি ও অনলাইনে নামজারি ফি প্রদানের ব্যবস্থা স্থাপনেরও উদ্যোগ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্লোগান ‘হাতের মুঠোয় ভূমিসেবা’। এর ধারাবাহিকতায় নাগরিকরা তাদের দোরগোড়ায় কম সময়ে, কম খরচে ভূমিসেবা পাচ্ছেন। ই-নামজারির সিস্টেম আরও সহজ করার কাজ চলছে। তখন আর জমির মালিককে ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রিসিপ্ট) কাটার টাকা জমা দিতে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যেতে হবে না।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারায় ২০২০ সালের ১৬ জুন জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতিসংঘ পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ বিজয়ী উদ্যোগের নাম ঘোষণা করে। বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় ‘স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিকাশ’ (ডেভেলপিং ট্রান্সপ্যারেন্ট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবল পাবলিক ইনস্টিটিউশনস) ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের মর্যাদাপূর্ণ ‘ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ ও ‘জাতিসংঘ জনসেবা পুরস্কার-২০২০’ অর্জন করে। চলতি বছরের ১৩ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের মদিনাত জুমেইরাহ সম্মেলন কেন্দ্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিকবিষয়ক বিভাগ কর্র্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত ‘ইউনাইটেড নেশনস পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এই পুরস্কার গ্রহণ করেন।

ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে প্রক্রিয়াধীন আবেদনসহ ৫৫ লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৪টি ই-নামজারি আবেদন পেয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪ লাখ ১৪ হাজার ৩১৯টি আবেদনের। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ২২ লাখের মতো ই-নামজারির আবেদনের মধ্যে ১৯ লাখের নিষ্পত্তি হয়েছে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত