মুক্তিযুদ্ধে ঘটনাবহুল আশুগঞ্জ

1016

Published on ডিসেম্বর 12, 2021
  • Details Image

অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজুঃ

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ছিল আশুগঞ্জ মুক্ত দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ও ঘটনাবহুল দিন। বিজয়ের ঊষালগ্নে ৯ ডিসেম্বর আশুগঞ্জে ভারতীয় মিত্রবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি শত্রু বাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ মুক্ত হয়েছিল। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাসহ বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সৈন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি আশুগঞ্জবাসী এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমি। ভৌগোলিক কারণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী ও শত্রু বাহিনী আশুগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আশুগঞ্জ নিয়ন্ত্রণ রাখা তখন উভয় পক্ষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ও বিজয়ের শেষ প্রান্তে আশুগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আশুগঞ্জই একমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে আকাশপথে যুদ্ধবিমান, নৌপথে গানবোট এবং স্থলপথে পদাতিক বাহিনীর ট্যাঙ্ক ব্যবহূত হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত গবেষণা এবং লেখালেখি হয়েছে সবখানেই ১৪ এপ্রিলের আশুগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং ৯ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ পুনরুদ্ধার যুদ্ধের বর্ণনা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ রয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব বীর যোদ্ধা মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছেন কিংবা বীরত্বের জন্য বিভিন্ন উপাধি লাভ করেছেন তাদের অনেকেই আশুগঞ্জের যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. এ এস এম নাসিম, মেজর জেনারেল মো. আবদুল মতিন, মেজর জেনারেল হেলাল মোরশেদ খান (তার শরীরে এখনও ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধের বোমার স্প্নিন্টার রয়েছে), মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া, মেজর জেনারেল আইন উদ্দিন ও মেজর নাসিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ গবেষণার ফসল আমার লেখা 'মুক্তিযুদ্ধ এবং আশুগঞ্জ' গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে একাত্তরের ১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 'আলফা কোম্পানি'র ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম ও লে. হেলাল মোরশেদ খান নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে বিমান হামলাসহ পদাতিক বাহিনী ব্যাপক হামলা চালায়। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী এ হামলায় আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মো. হোসেনসহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার সেরাজ, ল্যান্স নায়েক আ. হাই ও সৈনিক কফিল উদ্দিন শাহাদাতবরণ করেন। এ যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাসিম ও ডেপুটি কমান্ডার লে. হেলাল মোরশেদ খান আহত হন। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা হামলায় আশুগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকায় চারতলা বাজার হাটি ও ভৈরব থেকে মেঘনা ব্রিজ দিয়ে আশুগঞ্জে আক্রমণকারী বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যও নিহত হয়। এর মধ্যে কয়েকজন অফিসারও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।

১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ মুক্ত হলেও সেদিন আশুগঞ্জ বাজার যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত এক বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল। আশুগঞ্জ খাদ্য গুদাম এলাকায় রেললাইনের বাঙ্কারে পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। ১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হলেও নদীর ওপারে ভৈরব বাজারে তখন কয়েক হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান নিয়ে আশুগঞ্জে শেলিং করতে থাকে। আশুগঞ্জ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরাও ভৈরবে পাকিস্তানি হানাদারদের অবস্থানের ওপর পাল্টা আঘাত করতে থাকেন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হলেও মূলত ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকেই আশুগঞ্জ বাজার সবার জন্য উন্মুক্ত হয়।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক; সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ (স্বাশিপ)

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত