1132
Published on ডিসেম্বর 9, 2021শাহাব উদ্দিন মাহমুদঃ
চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে অভিযান ছিল মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডোদের প্রথম অপারেশন। মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন তাদের এই অভিযান সফল হলে বাঙালী জাতিকে তা এগিয়ে নেবে বিজয়ের বন্দরে। আর ব্যর্থতার ফল হবে মৃত্যু। এ কারণে লিম্পেট মাইন নিয়ে মরণপণ সেই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডোদের জন্য এক জীবনমরণ ক্ষণ সেই মধ্যরাত। তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল পলাশীর হরিণা ক্যাম্প থেকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হয়, তারা একযোগে পৌঁছে যাবেন স্ব স্ব এলাকা চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে। স্বাধীনতাযুদ্ধের এক কঠিনতম মুহূর্ত এই অপারেশন জ্যাকপট, যা মূলত নৌ-কমান্ডো পরিচালিত গেরিলা অপারেশন। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীরেরা ছিলেন আমাদের দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাদের জানাই অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরীণ সব নৌচলাচল, বন্দর ও উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১০ নম্বর সেক্টর, যা ছিল মূল নৌবাহিনী নিয়ে গঠিত। এ সেক্টরের কোন নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিল না। অপারেশন চলাকালে নৌ-কমান্ডোরা সংশ্লিষ্ট এলাকার সেক্টর কমান্ডারদের সহযোগিতায় সরাসরি মুজিবনগর সদর দফতরের অধীনে কাজ করতেন। পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস এ্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণরত ৪১ সাবমেরিনারের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালী এবং এরা আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ২৫ মার্চ গণহত্যার খবর শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে আটজন ৩০ মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন এবং ৯ এপ্রিল ১৯৭১ তারা ভারতের দিল্লীতে এসে পৌঁছান। তারা হলেন মোঃ রহমত উল্লাহ, সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, মোঃ শেখ আমানউল্লাহ, মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, মোঃ আহসানউল্লাহ, মোঃ আবদুর রকিব মিয়া, মোঃ আবদুর রহমান আবেদ, মোঃ বদিউল আলম। পরে এই আটজনের সঙ্গে আরও কয়েকজনকে যুক্ত করে মোট ২০ জনের গেরিলা দল গঠন করে তাদের ভারতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের দেশে পাঠানো হলে কর্নেল এমএজি ওসমানীর সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে বাছাই করা তিনশ’জনকে নিয়ে ২১ মে গঠন করা হয় নৌ-কমান্ডো বাহিনী। এমএজি ওসমানীর সিদ্ধান্তে নৌ-কমান্ডো সেক্টর খোলার পর বাছাই করা গেরিলাদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগিরথী নদীর তীরে ২৩ মে একটি গোপন প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এই প্রশিক্ষণ শিবিরের সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয় সি২পি।
প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই বাছাই করা প্রশিক্ষণার্থীদের ছবিসহ একটি স্মৃতিসূচক ফরমে স্বাক্ষর নেয়া হয়। ফরমে লেখা থাকত ‘আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।’ নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এমএন সামন্ত ও কমান্ডার জিএম মার্টিসসহ আরও ২০ জন ভারতীয় প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আটজন সাবমেরিনারও ছিলেন। প্রশিক্ষণার্থীদের তীব্র খরস্রোতা ভাগিরথী নদী ও নদীর তীরে স্থলযুদ্ধ ও জলযুদ্ধের কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। শীত-বর্ষায় টানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হয় সব যোদ্ধাকে। টানা প্রায় তিন মাস প্রশিক্ষণের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তা শেষ হয়। একই সময়ে দুই সমুদ্রবন্দর ও দুই নদীবন্দরে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা সাজানোর পাশাপাশি চার সেক্টরে পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচকে চার স্থানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মোট চারটি দলে ভাগ করা হয়। ৬০ জনের দুটি দল এবং ২০ জনের আরও দুটি দল। চারটি দলের চারজন নেতা ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। আগস্টের শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশনের জন্য মোঃ ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জন নৌ-কমান্ডোর একটি দলকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তার সঙ্গে ডেপুটি লিডার হিসেবে ছিলেন নৌ-কমান্ডো শাহ আলম। কলকাতার দমদম বিমানবন্দর থেকে আকাশপথে আগরতলায় পৌঁছায় নৌ-কমান্ডোদের দলটি। সেখান থেকে ১১ আগস্ট বাংলাদেশে তারা প্রবেশ করেন। টিম লিডারদের জানানো হয়েছে, অপারেশনের দিনক্ষণ জানাতে সঙ্কেত হবে দুটি গান। আকাশবাণী রেডিওতে ওই গান বাজলেই বুঝতে হবে সময় এসে গেছে। বিমানে জেনারেল অরোরা ওয়াহেদ চৌধুরীকে বললেন, ‘ডু ইউ নো ইওর ডি ডে?’ তিনি বলেছিলেন, নো স্যার। তখন জেনারেল অরোরা আভাস দিলেন- হয়ত ১৫ তারিখ হতে পারে। অপারেশন শুরুর সঙ্কেত হিসেবে ঠিক করা গান দুটি সম্প্রচার করা হবে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য কলকাতা আকাশবাণীর বিশেষ অনুষ্ঠানে, সকাল ৬টা থেকে সাড়ে ৬টা অথবা রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে। প্রচারের ফ্রিকোয়েন্সি আর গান দুটির কথা শুধু টিম লিডার ও ডেপুটি লিডারকেই বলা হয়। এর মধ্যে পঙ্কজ মল্লিকের ‘আমি যে তোমাকে শুনিয়েছি কত গান’ বাজলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশনে যেতে হবে। আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’ বাজার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে অপারেশন।
হরিণা ক্যাম্প থেকে আসা ৬০ জনের দলকে ২০ জন করে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ১ ও ২ নম্বর দল তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট বেজ ক্যাম্পের উদ্দেশে যাত্রা করে এবং ১৪ আগস্ট তারা প্রথম গানের সঙ্কেত পায়। এই সঙ্কেত পাওয়ার পর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে চরলক্ষ্যায় তাদের বেজ ক্যাম্পে পৌঁছায়। ১৫ আগস্ট তারা ট্রানজিস্টরে চূড়ান্ত সঙ্কেত পায় এবং অপারেশনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রাতেই জাহাজে মাইন লাগাতে হবে। সময় ঠিক রাখতে না পারলে চাঁদপুর, মংলা ও নারায়ণগঞ্জের অপারেশনের সময়ের সঙ্গে গরিমল হয়ে যাবে। সেই গান শুনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযান শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে রাত ১১টার আগেই কর্ণফুলী নদীর ওপারে পৌঁছায় ওয়াহেদ চৌধুরীর দলের দুই ভাগের ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা। ৩৩ জন ১১টা জাহাজে তিনজন করে এ্যাটাক করবে। প্রতিটিতে তিনটি করে মাইন ফিট করবে। পানির ছয় ফুট নিচের সামনে, পেছনে আর মাঝখানে। একেকটা টার্গেটে একেকটা জাহাজে তিনজন করে হিট করবে। আর সাতজন শেল্টারে দাঁড়াবে। রাত ১২টা বাজার ৫ মিনিট আগে পানিতে নামেন কমান্ডোরা। জাহাজে মাইন বসিয়ে সোয়া ১২টার মধ্যে আবার একসঙ্গে হয়ে যান। ফেলে দেন অন্যান্য সরঞ্জাম।
সুইমিং কস্টিউম পরা ৪০ জনের ওই দল গিয়ে অবস্থান নেয় একটি বাড়ির গোয়ালঘরে। এরপর বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনার অপেক্ষা। রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সব মাইন বিস্ফোরিত হয়। এ সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ ধ্বংস হয়। এই বড় জাহাজগুলো হলো (১) এমভি হরমুজ। এটি ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ৯৯১০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদবাহী এই জাহাজটি ১৩ নম্বর জেটিতে নোঙ্গর করা ছিল। (২) এমভি আল-আব্বাস। এটি ১০ হাজার ৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ৯ আগস্ট ১২ নম্বর জেটিতে অবস্থান নিয়েছিল। (৩) ওরিয়েন্ট বার্জ নম্বর ৬। এটি ৬ হাজার ২৭৬ টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে ফিশ হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল। একের পর এক মাইন বিস্ফোরণে জাহাজ তিনটিসহ পার্শ্ববর্তী অনেক জাহাজ বিধ্বস্ত হয় এবং পানিতে ডুবে যায়। ১৬ আগস্ট সকালে ছড়িয়ে পড়ল খবর। বলা হলো, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে নয়টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা’। পাকিস্তানীরা সারা ওয়ার্ল্ডে সিগন্যাল দিল চিটাগাং পোর্ট ইজ নন-অপারেশনাল, চিটাগাং পোর্ট ড্যামেজড বাই দি টেররিস্ট। সেই অভিযানে নয়টি জাহাজ ডুবিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেয়ার পর পাকিস্তানীদের মনোবল ও মেরুদ-ও ভেঙ্গে যায়।
লেখক : গবেষক
সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ
(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)